RE: প্রাচিনকালে মানুস কীভাবে জিবন যাপন করত?
প্রাচিনকালে মানুস কীভাবে জিবন যাপন করত?
প্রাচীনকালে মানুষ জীবনযাপন করত খুবই ভিন্নভাবে, কারণ তখনকার সমাজ, অর্থনীতি, এবং জীবনধারা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষের জীবন যাপন প্রাকৃতিক পরিবেশ, শিকার, কৃষি, এবং মুদ্রা ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে অনেকটাই স্বতন্ত্র ছিল। এখানে কিছু মূল দিক আলোচনা করা হলো:
১. শিকার এবং সংগৃহীত খাবার
প্রাচীন মানুষের জীবনে শিকার এবং প্রাকৃতিক উপাদান সংগ্রহ করা ছিল প্রধান জীবিকা। প্রাথমিক মানুষেরা সাধারণত খাদ্য সংগ্রহকারীদের (Hunters and Gatherers) মতো জীবনযাপন করত, যেখানে তারা বনজঙ্গল থেকে ফলমূল, বীজ, শিকারের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করত। তারা পশু শিকার করে অথবা মাছ ধরত এবং গাছপালা, ফলমূল সংগ্রহ করে খাবার জোগাড় করত।
২. কৃষিকাজের শুরু
খ্রিষ্টপূর্ব ১০,০০০-৮,০০০ বছর আগে মানুষ কৃষিকাজ শুরু করে, বিশেষত নদী উপত্যকায় যেখানে প্রাকৃতিকভাবে জমির উর্বরতা বেশি ছিল। এরপর থেকে মানুষ বিভিন্ন শস্য, যেমন গম, যব, চাল, মিষ্টি আলু, মটরশুটি ইত্যাদি চাষ করতে শুরু করে। কৃষিকাজের ফলে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা তৈরি হয় এবং এটি সভ্যতার অগ্রগতির প্রথম পদক্ষেপ।
৩. বাসস্থান
প্রাচীনকালে মানুষ সাধারণত গুহায় বা অস্থায়ী শিবিরে বাস করত। কৃষি সমাজের উদ্ভবের পর, মানুষ এক স্থানে বসবাস শুরু করেছিল এবং সেইভাবে গ্রাম বা শহর স্থাপন করা শুরু হয়। শুরুতে বাসস্থান ছিল খুবই সাধারণ, কাঠ, মাটি, পশুর ত্বক বা গাছের পাতা দিয়ে তৈরি, এবং ভবিষ্যতে ইট-পাথর দিয়ে বাসস্থান গড়ে ওঠে।
৪. সমাজ ও পরিবার
প্রাচীন সমাজগুলো সাধারণত একটি ছোটখাটো সম্প্রদায় হিসেবে গঠিত ছিল, যেখানে সবাই একে অপরের সাথে সহযোগিতা করত। সমাজে কাজের ভাগাভাগি ছিল—পুরুষরা প্রধানত শিকার এবং কৃষিকাজে যুক্ত থাকত, আর নারীরা গৃহকর্ম, শিশুদের দেখাশোনা এবং খাদ্য প্রস্তুতিতে সাহায্য করত। পরিবারগুলো বড় হতে পারে, এবং কখনও কখনও একাধিক প্রজন্ম একসাথে বাস করত।
৫. ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা
ধর্ম প্রাচীন মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা বিভিন্ন ধরনের দেব-দেবীর পূজা করত এবং তাদের বিশ্বাস ছিল যে প্রকৃতির শক্তি এবং জীবজন্তুর মধ্যে কোনো না কোনো দেবতা বা শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন সমাজে ভিন্ন ভিন্ন ছিল, তবে সাধারণত প্রকৃতির উপাদান (সূর্য, বৃষ্টি, আকাশ, পাখি, পশু ইত্যাদি) কে সম্মান জানানো হতো।
৬. কला এবং সংস্কৃতি
প্রাচীন মানুষ সাধারণত গুহাচিত্র (cave paintings), ভাস্কর্য, এবং অন্যান্য প্রাথমিক শিল্পকলার মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি এবং চিন্তা প্রকাশ করত। বিশেষ করে, প্রাচীন গুহাচিত্রে পশু শিকার, শিকারী ও পুরাণের কাহিনী অঙ্কিত ছিল। সংগীত, নাচ, এবং আধ্যাত্মিক রীতিনীতি বিভিন্ন সমাজে ছিল।
৭. উন্নত প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম
প্রাচীন মানুষ সরঞ্জাম তৈরি করার জন্য পাথর, কাঠ, মাটির তৈরি নানা ধরনের উপকরণ ব্যবহার করত। পাথরের ছুরি, শাবল, অস্ত্র তৈরি ছিল তাদের প্রধান উপকরণ। পরে তামা, তলোয়ার, ধাতু ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু হয়, যা কৃষি, নির্মাণ, ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটায়।
৮. ব্যবসা ও বাণিজ্য
যতই সময় এগিয়েছে, ততই বাণিজ্যেরও উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে (যেমন, মেসোপটেমিয়া, মিশর, ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন) ব্যবসার বিকাশ ঘটেছিল। সেখানে মূলত মূল্যবান পণ্য (যেমন, রত্ন, তামা, মশলা) এর আদান-প্রদান করা হতো। অনেক সময় মানুষ সামান্য পণ্য বিনিময় (barter system) পদ্ধতিতে ব্যবসা করত, অর্থাৎ কোনো পণ্য বা সেবা সরাসরি অন্য পণ্যের মাধ্যমে বিনিময় করা হতো।
৯. শাসন ও সরকার
প্রাচীন সমাজে শাসন ব্যবস্থা সাধারণত রাজতন্ত্র ছিল, যেখানে একজন শাসক বা রাজা সমগ্র সমাজের দায়িত্বে থাকতেন। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে রাজা, ধনবান ও ধর্মীয় নেতারা সমাজের ক্ষমতা ধারণ করতেন। তাঁদের ক্ষমতা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থিত ছিল।
১০. শিক্ষা এবং জ্ঞান
প্রাচীন সমাজে শিক্ষার ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত ছিল। শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি জানানো, যেমন মিশরের পিরামিড নির্মাণ, মেসোপটেমিয়ার কনুইফর্ম লেখার ধারণা, এবং ভারতীয় উপমহাদেশে বৈদিক জ্ঞান। সাধারণ মানুষ প্রধানত কৃষিকাজে দক্ষ হতো, তবে উচ্চ শ্রেণীর মানুষই লেখাপড়া, বিজ্ঞান, গণিত, এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান শিখত।
সার্বিকভাবে:
প্রাচীন মানুষ তার জীবনযাপনকে প্রকৃতি ও জীবনধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত রাখত। তারা একে অপরের সাহায্যে জীবিকা নির্বাহ করত এবং প্রকৃতি ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকত। শিকার, কৃষি, সমাজ ও সংস্কৃতি এই সবগুলো বিষয়ই তাদের জীবনের মূল অঙ্গ ছিল।