মুসলিম হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে : ইসলাম কী বলে ?

মুসলিম হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে : ইসলাম কী বলে ?

Add Comment
1 Answer(s)

    মুসলিম হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে এবং মুমিন দাসী মুশরিক নারীর চেয়ে নিশ্চয় উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। আর মুশরিক পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। আর একজন মুমিন দাস একজন মুশরিক পুরুষের চেয়ে উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। তারা তোমাদেরকে আগুনের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ তার অনুমতিতে তোমাদেরকে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন এবং মানুষের জন্য তার আয়াতসমূহ স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ২২১)

    আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট হলো, রাসুল (সা.) আবূ মারছিদ নামক এক সাহাবীকে মক্কায় পাঠান গোপনে গিয়ে সেখানে থেকে যাওয়া লোকদের আনতে। তিনি সেখানে পৌঁছলে ‘ইনাক নামক এক মুশরিক নারী তার কথা শুনতে পায়। সে ছিল তার জাহেলী যুগের বান্ধবী। সে তার কাছে এসে বলল, হে আবু মারছিদ তুমি কি আমায় সান্নিধ্য দেবে না? তিনি বললেন, ধ্বংস হও তুমি হে ‘ইনাক, ইসলাম এখন আমাদের মাঝে ওই কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। সে বলল, তবে কি তুমি আমায় বিয়ে করতে পার? তিনি বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু আমাকে আগে রাসুল (সা.) এর কাছে যেতে হবে। তার কাছে আমি (তোমাকে) বিয়ে করার অনুমতি প্রার্থনা করব। সে বলল, তুমি আমাকে উপেক্ষা করছ? অতপর মেয়েটি তার বিরুদ্ধে (নিজ গোত্রীয়) লোকদের সাহায্য চাইল। তারা তাকে বেদম প্রহার করল। তারপর তার পথ ছেড়ে দিল। মক্কায় নিজের কাজ সেরে তিনি যখন রাসুল (সা.) এর কাছে গেলেন, তাকে তিনি নিজের অবস্থা, ‘ইনাকের বিষয় এবং এ জন্য প্রহৃত হবার ঘটনা জানালেন। তারপর বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার জন্য কি তাকে (মুশরিক নারীকে) বিয়ে করা হালাল হবে? তখন আল্লাহ এই আয়াতটি নাযিল করেন। (তাফসীর তাবারী : ৪/৩৬৪)

    এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম ইবনু জারীর আত-তবারী (রহ.)বলেন- ‘আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর বিশারদগণ এ ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন যে, এতে সকল মুশরিকের কথা বলা হয়েছে নাকি কতিপয় মুশরিকের কথা। আর আয়াতটি নাযিল করার পর এর কিছুকে মানসুখ বা রহিত করা হয়েছে কী-না। তাদের কেউ বলেছেন, আয়াতে সকল মুসলিমের জন্য সব মুশরিক নারীর বিবাহকে হারাম বুঝানো হয়েছে। চাই সে যে কোনো ধরনের শিরকেই লিপ্ত থাকুক না কেন। হোক সে মূর্তিপূজারী, ইহুদি, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজারী বা অন্য কোনো ধরনের শিরকে লিপ্ত কেউ।

    অতঃপর আহলে কিতাবদের বিয়ে হারামের বিয়ষটি রহিত ঘোষণা করা হয় নিচের আয়াতের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা তাতে ইরশাদ করেন- ‘আজ তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো সব ভালো বস্তু এবং যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে, তাদের খাবার তোমাদের জন্য বৈধ এবং তোমার খাবার তাদের জন্য বৈধ। আর মুমিন সচ্চরিত্রা নারী এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের সচ্চরিত্রা নারীদের সঙ্গে তোমাদের বিবাহ বৈধ। যখন তোমরা তাদেরকে মোহর দেবে, বিবাহকারী হিসেবে, প্রকাশ্য ব্যভিচারকারী বা গোপনপত্নী গ্রহণকারী হিসেবে নয়।’ (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৫)

    এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সতী-সাধ্বী খ্রিস্টান ও ইহুদীদের বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন। (তাফসীরে তাবারী : ৪/৩৬৩; আল-ওয়াসিত : ৩২০-৩২১)

    একই শাস্ত্রের আরেক ইমাম ইবন কাছীর (রহ.)বলেন- ‘এ আয়াতে আল্লাহ সাধারণভাবে শিরকে লিপ্ত সব নারীকে বিয়ে করা হারাম ঘোষণা করেছেন, চাই সে মূর্তিপূজক কিংবা আহলে কিতাব সম্প্রদায়ভুক্ত হোক। তবে পরবর্তীতে মায়িদার আয়াতে তাদের মধ্যে কেবল আসমানী কিতাবধারী সচ্চরিত্রা নারীদের বিশেষভাবে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’ ( তাফসীরে ইবন কাছীর : ১/৪৭৪)

    উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে প্রতিভাত হয় যে, বিশেষ কিছু শর্ত সাপেক্ষেই কেবল খ্রিস্টান বা ইহুদি নারীকে কোনো মুসলিম বিয়ে করতে পারে।

    এক. বাস্তবিকই আহলে কিতাব হতে হবে। শুধু নামে ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান হলে চলবে না। নামে ইহুদি-খ্রিস্টান অথচ সে নাস্তিক কিংবা নিজ ধর্মকে বিশ্বাস করে না, তাহলে চলবে না।

    দুই. অবশ্যই তাকে পবিত্র হতে হবে। ব্যভিচারিণী হলে চলবে না।

    তিন. এমন কাউকে বিয়ে করা যাবে না, যার জাতি পুরো মুসলিম উম্মতের সঙ্গে ঘোর শত্রুতা পোষণ করে, যেমন : বর্তমান সময়ের ইসরাইলের ইহুদিরা।

    চার. বিয়ের কারণে স্বামীর সন্তানের কোনো বৈষয়িক ক্ষতি সাধিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও আহলে কিতাব বিয়ে করা যাবে না। (তাফসীরে কুরতুবী : ৩/৬৭-৬৯)

    আন্তধর্ম বিয়ের ভয়াবহ পরিণতি

    বিয়ে একটি ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন। নিজের খেয়াল-খুশি মতো এ বন্ধনের নিয়মে ব্যত্যয় ঘটাবার সুযোগ নেই। ইসলাম মানবজীবনের সব পর্যায়ের যাবতীয় উপলক্ষ ও অনুসর্গকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কেমন হবে, দিয়েছে তার দ্ব্যর্থহীন দিকনির্দেশনা। এই জীবনদিশা আল্লাহ প্রদত্ত বিধায় এর মধ্যে কোনো গলদ নেই। সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিয়ে সম্পর্কিত আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণের বিকল্প নেই। এর বাইরে যাওয়ার চেষ্টা মানেই নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে আনা। ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম দিয়ে বল্গাহীনভাবে কিছু করার স্বাধীনতা ইসলামে নেই। যারা নিজের স্বাধীনতা দিয়ে অন্যের ধর্ম, সম্মান, রীতি-নীতি ও স্বাধীনতাকে নষ্ট করে তারা মানবতার শত্রু।

    আন্তধর্ম বিয়ের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। বাংলাদেশে আগে দেখা যেত, কেউ নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করতে হতো বিধায় সহজে কেউ ও পথে হাঁটতো না। এখন বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে। ধর্ম ত্যাগ না করেই তরুণ-তরুণীরা তাদের রঙ্গলীলা সাঙ্গ করতে নেমে পড়বে। কোনো ধর্মের স্বকীয়তা আর থাকবে না। যার ফল দাঁড়াবে অদূর ভবিষ্যতে গোটা সমাজ ব্যবস্থাই ধর্মহীন হয়ে পড়বে। যিনা-ব্যভিচার ডাল-ভাতে পরিণত হবে। জন্ম নেবে জারজ সন্তান। একদিন জারজ সন্তানে দেশ ভরে যাবে। আর এই ব্যভিচার নামক গর্হিত কাজটি আল্লাহর কিতাব, রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ ও সমগ্র উম্মাহর ঐক্যমত্যে হারাম।

    আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সুরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৩২)

    ব্যভিচার তো দূরের কথা ইসলামে যে কোনো ধরনের অশ্লীলতাকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘বল, ‘আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ, যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সঙ্গে তোমাদের শরিক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না।’ ({সুরা আল-আরাফ, আয়াত : ৩৩)

    অন্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন- ‘বল, ‘এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি। তা এই যে, তোমরা তার সঙ্গে কোন কিছুকে শরিক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিযক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না, তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।’(সুরা আল-আনআম, আয়াত : ১৫১)

    যিনা-ব্যভিচারের ভয়াবহতা তুলে ধরে রাসুল (সা.) বারবার মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন।

    হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যিনাকারী মুমিন থাকে না যখন সে যিনা করে, আর মদ্যপ মুমিন থাকে না যখন মদ পান করে, চোর মুমিন থাকে না যখন সে চুরি করে, ছিনতাইকারী মুমিন থাকে না যখন সে কোনোরূপ ছিনতাই করে আর লোকেরা তার দিকে (বিস্ময় বিস্ফোরিত নেত্রে) চেয়ে থাকে।’ (বুখারী : ২৪৭৫, মুসলিম : ৫৫৩)

    হযরত আবদুর রহমান ইবন সাখার (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘বান্দা যখন যিনা করে তখন তার কাছ থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং তা ছায়ার মতো (শূন্যে) দুলতে থাকে। অতপর যখন সে ওই কাজ থেকে নিবৃত হয়, তখন তার কাছে ঈমান ফিরে আসে।’ (আল-মুস্তাদরাক আলাস-সাহীহাইন : ৫৫, বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৪৯৬৪)

    পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত : ৮৫)

    কেউ সুন্দরী বিধর্মী নারীতে মজে আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করবেন আর নিজেকে খুব ভালো মুসলিম ভেবে আবার তৃপ্তও হবেন তা কিন্তু হয় না। তারা মূলত বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কিছু মানা আর কিছু না মানার কোনো সুযোগ ইসলামে রাখা হয়নি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ৮৫)

    নিজের মন মতো নয়, আমাদের সব কাজ হতে হবে আল্লাহর রাসুল (সা.) এর আদর্শ অনুযায়ী। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত : ৬৫)

    Professor Answered on April 6, 2015.
    Add Comment
  • RELATED QUESTIONS

  • POPULAR QUESTIONS

  • LATEST QUESTIONS

  • Your Answer

    By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.