রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
হিমোগ্লোবিন একটি অক্সিজেনবাহী লৌহসমৃদ্ধ মেটালোপ্রোটিন যা মেরুদণ্ডী প্রাণিদের লোহিত কণিকা এবং কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণিকলায় পাওয়া যায়। মূলত হিমোগ্লোবিন হলো এক ধরনের প্রোটিন। এটি মানুষের শরীরে লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে থাকে। এটা আমাদের শরীরে অক্সিজেন পরিবহনে সাহায্য করে। মানুষের শরীরের ভিতরে প্রত্যেক জায়গায় অক্সিজেন পৌঁছে দেবার কাজ হলো হিমোগ্লোবিনের । অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে অক্সিজেন পরিবহনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ যদি কমে যায় তাহলে অক্সিজেন সরবরাহও কমে যাবে। তখন অ্যানিমিয়ার লক্ষণসমূহ দেখা দিবে।
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা :
আমাদের শরীরে রক্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লোহিত রক্তকণিকা, আর লোহিত রক্তকণিকার প্রাণ হচ্ছে হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো ফুসফুস থেকে দেহকোষে অক্সিজেন পরিবহন করা। আবার আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন। কোনো কারণে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বা পরিমাণ কমে গেলে সেই অবস্থাকে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা বলা হয়।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা :
বয়স ও লিঙ্গ অনুসারে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ভিন্ন। সাধারণত জন্মের সময় নবজাতক শিশুর দেহে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ থাকে ২০০ গ্রাম/লিটার। পরবর্তীকালে তিন মাস বয়স থেকে তা কমতে থাকে এবং প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। পরে প্রাপ্ত বয়সের সময় হিমোগ্লোবিন আবার বাড়তে শুরু করে। পুরুষদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১৩০-১৮০ গ্রাম/ লিটার আর মহিলাদের ক্ষেত্রে ১১৫-১৬৫ গ্রাম/লিটার। এ ক্ষেত্রে পুরুষ কিংবা মহিলা যেই হোক যদি কারো হিমোগ্লোবিনের ৭০ কিংবা ৮০ গ্রাম/লিটার হয়ে থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে মারাত্মক অ্যানিমিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
অ্যানিমিয়ার লক্ষণ/হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে শারীরিক সমস্যা :
বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই অ্যানিমিয়ার নির্দিষ্ট লক্ষণ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না, কিংবা লক্ষণ দেখে অ্যানিমিয়া রোগী চিহ্নিত করা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে বেশকিছু লক্ষণ প্রায় একই সঙ্গে থাকলে রক্ত পরীক্ষা করা খুবই জরুরি।
১. শরীর ফ্যাকাসে থাকবে ও প্রচুর ঘাম হবে।
২. বুক ধড়পড় করবে।
৩. নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হবে।
৪. মাথা ঘোরার সঙ্গে মাথা ব্যথাও থাকবে।
৫. চোখে ঝাপসা কিংবা কম দেখবে।
৬. মুখের কোণে ও জিহ্বায় ঘা।
৭. লৌহের অভাবজনিত সমস্যা কইলোনশিয়া।
৮. দুর্বলতা ও ক্লান্তিভাব।
৯. হজমে সমস্যা।
১০. পুরো শরীর ফুলে যাওয়া।
১১. পা ফুলে যাওয়া।
১২. শ্বাসকষ্ট।
১৩. অনিদ্রা কিংবা ঘুম কম হওয়া।
১৪. এনজাইনা।
১৫. হৃৎপিন্ড বড় হয়ে যাওয়া।
১৬. দ্রুত হার্টবিট।
অ্যানিমিয়ার কারণ :
দেহের হিমোগ্লোবিনে বিদ্যমান আয়রনই ফুসফুসে অক্সিজেন সংগঠিত করে ও দেহ কোষে এনার্জি বা শক্তির জন্য সেই অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয়। তাই আয়রনের অভাবকে অ্যানিমিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কারণগুলো হচ্ছে :
– অপর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন উৎপাদন।
– অতিমাত্রায় লোহিত রক্তকণিকার ধ্বংস।
– কৃমি, বিশেষ করে হুকওয়ার্মের কারণে সৃষ্ট আয়রনের অভাব ও রক্তক্ষরণ।
– অতিরিক্ত মাসিক স্রাব।
– ঘন ঘন গর্ভধারণ ও স্তন্যদান।
– ফলিক এসিড, ভিটামিন এ ও ভিটামিন বি-১২ এর অভাব।
– থ্যালাসেমিয়া অর্থাৎ জন্মগতভাবে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সমস্যা।
– গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি।
– হাইপোথইরয়ডিজম।
– লিভার সমস্যা।
– ম্যালেরিয়া জ্বর।
– অ্যালকোহল পানীয় গ্রহণ।
– মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি।
চিকিৎসা
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার চিকিৎসা প্রায় এর প্রতিরোধ ব্যবস্থাই। অ্যানিমিয়া হলে প্রচুর আয়রন, ভিটামিন ও ফলেটযুক্ত খাদ্য ও ওষুধ সেবন করতে হবে। তবে অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সেই অনুযায়ী চিকিৎসা ও সেবা প্রয়োজন। তাই অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার ব্যাপারে অসচেতনতা বা উদাসীনতা পরিহার করার সময় এখনই, নয়তো প্রতিদিনই ঘরে ঘরে মারা যেতে পারে গর্ভবতী মা ও নিষ্পাপ শিশু। ধন্যবাদ