সাংখ্য দর্শনের সঙ্গে বাস্তবের মিলটা কোথায়?
সাংখ্য দর্শনের সঙ্গে বাস্তবের মিলটা কোথায়?
এটা সম্পূর্ণই নির্ভর করছে “সাংখ্য দর্শন” আর “বাস্তব” বলতে আপনি কী বোঝেন তার উপর । যদি “বাস্তব” অর্থে সামাজিক বাস্তব ধরে নিই তবে সাংখ্য দর্শনের মধ্যে প্রাক-বৈদিক যুগের কৃষিপ্রধান মাতৃতান্ত্রিক সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, যেটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তান্ত্রিক ধ্যানধারণার সাথে সাংখ্যের দার্শনিক তত্ত্বের মিল লক্ষ্য করলে — তন্ত্রের ধারণা অনুযায়ী মানবদেহ যে পদ্ধতিতে সৃষ্ট হয় (অর্থাৎ নর-নারীর মিলনে), আমাদের বিশ্বব্রহ্মান্ডও অনুরূপ পদ্ধতিতে সৃষ্ট হয় (প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে); সাংখ্যেও তেমনই প্রকৃতি ও পুরুষের লীলায় জগতের সৃষ্টি । উভয় ক্ষেত্রেই প্রকৃতিকে নারী হিসেবে কল্পনা করা হয় এবং যেটা লক্ষ্যণীয়, পুরুষকে উদাসীন ও গৌণ রূপে কল্পনা করা হয় । অর্থাৎ সৃষ্টিতে পুরুষের ভূমিকা অপ্রধান, প্রকৃতিই প্রধান ।
সাংখ্য দর্শনকে “প্রাক-বৈদিক” ও “মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিচ্ছবি” বলাতে পাঠক যদি অবাক হয়ে থাকেন তবে এমন দাবীর প্রধান কারণের মধ্যে এটা একটা । বৈদিক সমাজ যেখানে নিঃসন্দেহে পুরুষপ্রধান সেখানে সাংখ্য বৈদিক দর্শন হলে পুরুষ অপ্রধান ও প্রকৃতি প্রধান হতো না । বরং মাতৃপ্রধান সমাজে উদ্ভূত হলেই এমন সম্ভাবনা বেশি । সেক্ষেত্রে এই ধারণাই করতে হয় যে সাংখ্যর উৎপত্তি বেদ কিংবা উপনিষদে হয়নি, বরং তা আরোই প্রাচীন একটি দর্শন ।
অবশ্য শুধু এই যুক্তির ভিত্তিতে এমন দাবী প্রতিষ্ঠা করা যায় না, কারণ এই প্রতিযুক্তি দেওয়া যায় যে সাংখ্যের পুরুষ হল অনাদি, অনন্ত আত্মা । উপনিষদে পুরুষকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, যা হতে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই, যিনি শেষ ও পরা গতি ইত্যাদি । কিন্তু উপনিষদের এই বক্তব্যে কি ধন্দ আরও বেড়ে যায় না? যে পুরুষ সাংখ্য মতে অপ্রধান বলে গণ্য হয়েছে তাকেই আবার “শ্রেষ্ঠ” বলাটা কি স্ববিরোধী হয়ে যায় না?
এখানেই শেষ নয়; দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের “লোকায়ত দর্শন”এ খুব স্পষ্টভাবেই এই মত দেওয়া হয়েছে যে আদি-সাংখ্যে, অর্থাৎ কিনা প্রাক-বৈদিক সাংখ্যে, পুরুষ বলতে কোনো আত্মা বা আধ্যাত্মিক সত্তাকে বোঝানো হতো না, বরং রক্তমাংসের দেহবিশিষ্ট মানুষ কল্পনা করা হয়েছে । “পুরুষ”কে আত্মার পরিভাষায় পরিণত করাটা বৈদিক চিন্তার স্বাক্ষর ।
তবে এর চাইতেও জোরালো যুক্তি যেটা তা হল ব্রহ্মসূত্রের রচয়িতা বাদরায়ণ মুনি এবং পরবর্তীতে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য উভয়েই তাঁদের গ্রন্থে সাংখ্য মতকে (বিশেষত, জড় প্রকৃতি জগৎকারণ এই মতকে) খণ্ডন করবার প্রয়াসের পরিচয় রেখে গিয়েছেন । এক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে প্রশ্ন ওঠে যে সাংখ্য বৈদিক দর্শন হলে তাকে খণ্ডন করার প্রয়োজন পড়বে কেন? তবে কি এটাই বুঝতে হয় যে আদি সাংখ্য দর্শনের মধ্যে বেদবিরোধী চিন্তার প্রকাশ ছিল, যাকে ক্ষুণ্ণ করতেই এই আয়োজন? যে আয়োজনের ফলে সাংখ্যের পুরুষ শুদ্ধচৈতন্য আত্মায় পরিণত হয়েছে আর সাংখ্য তত্ত্ব হয়ে উঠেছে অধ্যাত্মবাদী?
শেষ করার আগে সম্পূর্ণতার খাতিরে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সমীচীন, যেটা হল প্রকৃতিই যদি সৃষ্টির প্রধান কারণ হয়ে থাকে তবে পুরুষের ধারণার আদৌ প্রয়োজন হলো কেন? পুরুষকে বাদ রেখেই তো দর্শন গড়ে উঠতে পারতো ।
এর উত্তর পাওয়া যায় মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই । বস্তুত এমন সমাজে পুরুষের একমাত্র ভূমিকা হল জন্মদাতার । তাঁর সন্তানের সাথে পুরুষটির কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে না যেহেতু তাঁরা মায়ের বংশের অন্তর্গত, এমনকি স্ত্রীর আত্মীয়ের কাছেও পুরুষটি আগন্তুক মাত্র থেকে যায় । সুতরাং, সমাজে পুরুষের এমন গৌণ ভূমিকার প্রতিফলন যে তার দর্শনেও ঘটবে এমনটাই আশা করা যায় ।
পরিশেষে বলি, এই উত্তর আমার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং প্রায় পুরোটাই ধার নেওয়া হয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের “লোকায়ত দর্শন” বইটির আলোচনা থেকে । আগ্রহী পাঠকদের স্বার্থে প্রাসঙ্গিক অংশটুকুর লিংক নিচে দেওয়া হল—