নিজের শরীর থেকে নিজ আলাদার ব্যাখা কি?
নিজের শরীর থেকে নিজ আলাদার ব্যাখা কি?
নিজের শরীর থেকে নিজে আলাদা হওয়া হচ্ছে ধ্যানের একটি সর্বোচ্চ পর্যায়, যেখানে নিজের শরীর নিয়ে নিজের কোনোরূপ অনুভূতিই কাজ করবে না। এরকম একটা অবস্থা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়।
মহাবতার বাবাজীর শিষ্য, ক্রিয়াযোগ এর প্রাণপুরুষ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় ছিলেন সংসারে থেকেও সংসার বিচ্ছিন্ন এক মহাযোগী। সংসারের যাবতীয় দ্বায়িত্ব পালন করতেন, অথচ সর্বক্ষণই অর্ধনিমীলিত চক্ষে ধ্যানস্থ অবস্থায় থাকতেন। ঠিক যেন সংসারে থেকেও সংসার থেকে কোটি যোজন দূরে এক অন্য লোকে।
তিনি, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে থাকতেন বারাণসীতে। একদিন সকালবেলা লাহিড়ী মহাশয় প্রাত:স্নান করতে গঙ্গানদীতে গেছেন। স্নান সেরে যখন হেঁটে বাড়ীতে ফিরছেন, তাঁর পায়ের উপর উড়ে এসে পড়লো একটা পাথরের টুকরো। পা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। লাহিড়ী মহাশয় একটুকরো ছেঁড়া কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থানটা বেঁধে বাড়ীতে ফিরে দোতলায় উঠে গেলেন।
বাড়ীতে ফেরার কিছুক্ষণ পর বাড়ীর লোকেরা দেখলেন বাড়ীর গেইট থেকে ঘর হয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। তাঁরা তখন এটা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে দেখতে পেলেন লাহিড়ী মহাশয়ের একটি পা থেকে রক্ত ঝরছে। লাহিড়ী মহাশয়কে জিজ্ঞেস করে তাঁরা জানতে পারলেন, গঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার পথে লাহিড়ী মহাশয়ের পায়ের উপর একটা ঢিল এসে পড়েছে এবং লাহিড়ী মহাশয় একটুকরো কাপড় পায়ে বেঁধে রেখেছেন।
যেটা দেখে সকলে অবাক হলেন, ওই ঢিলটি লাহিড়ী মহাশয়ের ডান পায়ে লেগে ডান পা কেটে গেছে অথচ লাহিড়ী মহাশয় ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোটি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন তাঁর বা পা টি।
এরকমই হয়। জগতে থেকে জগতের নিয়মই পালন করে যেতে হয়, শরীরের কোনো জায়গা কেটে গেলে, রক্তপাত বন্ধ করার জন্য কাপড় দিয়ে বাঁধা জগতেরই নিয়ম, কিন্তু, লাহিড়ী মহাশয় যে ছিলেন যোগীরাজ, মহাযোগী। জাগতিক নিয়মের পালন করেও, তিনি অবস্থান করতেন জাগতিক অনুভূতির ঊর্ধ্বে। তাই, পা কেটে গিয়েছে, কাপড় দিয়ে বাঁধতে হবে, বেঁধেছেন, কিন্তু, কোন পা কেটেছে, সেটার খেয়ালই যে নেই, কারণ, তিনি যে নিজের শরীর থেকে নিজেকে এক অপরিমেয় দূরত্বে আলাদা করে রাখতে জানতেন, যে দূরত্বে পা অক্ষত থাকা বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যবধান ঘুচে যায়।
যোগীরা বলেন, আমাদের দেহ বা শরীরের দুটো ভাগ রয়েছে, একটি রক্ত মাংস হাড় দিয়ে তৈরী স্থূল দেহ আর একটি হচ্ছে সুক্ষ্ম দেহ।
স্থুল শরীরের অনুভূতি আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু, সূক্ষ শরীর সম্পর্কে আমরা সচেতন নই।
যোগী ঋষিগণ তাঁদের সাধন পদ্ধতির দ্বারা নিজেকে যখন স্থূল থেকে সুক্ষ্ম দেহে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হন, সেই সুক্ষ্ম দেহের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রোগ, ব্যথা, কষ্ট এসব অনুভূতি থাকে না।
স্থূল দেহে বিরাজ করেও যিনি নিজেকে সুক্ষ্ম দেহে বিরাজিত করে রাখার মতো ঐশী ক্ষমতা ধারণ করেন, তিনিই নিজের শরীর থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে জানেন।
ধন্যবাদ।