জীবনের উদ্দেশ্য কি পরকালীন উদ্দেশ্যের সাথে সংযুক্ত নয়?
জীবনের উদ্দেশ্য কি পরকালীন উদ্দেশ্যের সাথে সংযুক্ত নয়?
হ্যাঁ, জীবনের উদ্দেশ্য পরকালীন উদ্দেশ্য বা চেতনার সাথে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত।
এজন্য আখেরাতের ধারণা যেভাবে মুহাম্মাদ (সা) পেশ করে গেছেন, তার আগেকার নবীরা ও ঠিক তেমনি করে তা পেশ করে এসেছিলেন এবং প্রত্যেক যামানায় মুসলমান হওয়ার জন্য এটা ছিল অপরিহার্য শর্ত। যে ব্যক্তি আখেরাতকে অস্বীকার করেছে অথবা সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, সকল নবীই তাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন, কেননা এ ধারণা ব্যতীত আল্লাহকে তার প্রেরিত কিতাব ও রাসূলদেরকে মেনে নেয়া সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে যায় এবং মানুষের সমগ্র জীবনই হয় বিকৃত। বিশেষভাবে চিন্তা করে দেখলে সহজেই কথাটি হৃদয়ংগম করতে পারা যাবে:
কাউকে যখন কোন কাজের কথা বলা হয়, তখন সবার আগে তার মনে প্রশ্ন জাগেঃ একাজ করলে কি লাভ হবে, আর না করলেই বা কি ক্ষতি হবে? এ প্রশ্ন কেন জাগে? যে কাজে কোন লাভ নেই মানুষ তাকে মনে করে অর্থহীন ও ব্যর্থ। যে কাজ সম্পর্কে মানুষের অন্তরে প্রত্যয় রয়েছে যে তাতে কোন ফায়দা হবে না, তা করার জন্য মানুষ কখনো তৈরী হবেনা। তেমনি এমন কোন কাজ থেকে কেউ বিরত হয়ে থাকতে রাযী হবে না, যাতে কোন ক্ষতি হবে না বলে প্রত্যয় রয়েছে। সন্দেহের ক্ষেত্রেও এ একই অবস্থা। যে কাজের লাভ সম্পর্কে কারো সন্দেহ রয়েছে তাতে সে কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারবে না। কোন কাজ ক্ষতিকর কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে তা থেকে বেঁচে থাকবার জন্য সে কোন বিশেষ চেষ্টা করবে না।
শিশুদের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মেলে। শিশুরা আগুনে হাত দেয় কেন? তার কারণ হচ্ছেঃ তাদেও মনে প্রত্যয় নেই যে, আগুন পুড়িয়ে দেয়। আবার পড়াশুনা থেকে তারা কেন দূরে থাকতে চায়? তার কারণ হচ্ছেঃ তাদের গুরুজনরা এ থেকে যেসব কল্যাণ প্রাপ্তির কথা তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করেছেন তা তাদের মনে লাগছেনা। অনুরূপ কারণেই যে লোক আখেরাতে বিশ্বাসী নয় সে আল্লাহকে মানা ও তার ইচ্ছাঅনুযায়ী চলাকে মনে করে নিষ্ফল। তার কাছে আল্লাহর আনুগত্য যেমন কোন লাভ নেই, তেমনি তার না-ফরমানীতে ও কোন ক্ষতি নেই। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর রাসূল ও কিতাবের মাধ্যমে যেসব আদেশ দিয়েছেন, তার আনুগত্য করা তার পক্ষে কি করে সম্ভব হবে? যদি ধরে নেয়া যায় যে সে আল্লাহকে মেনে নিয়েছে তা হলেও তার সে মানা সম্পূর্ণ নিরর্থক, কেননা সে আল্লাহর প্রদত্ত আইনের আনুগত্য করবেনা এবং তার ইচ্ছা অনুসারে চলবে না।
এখানেই ব্যাপারটি শেষ নয়!
আরো ভাল করে চিন্তা করলে বুঝতে পারা যায় যে, আখেরাতের স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি মানুষের জীবনে চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে এমনি যে, সে যে কোন কাজ করার বা না করার সিদ্ধান্ত করে লাভ ক্ষতির দিক বিবেচনা করে। এখন এক ব্যক্তির নযর কেবল দুনিয়ার লাভ-ক্ষতির উপর নিবদ্ধ। এমন কোন সৎকাজের প্রবনতা তার মধ্যে কখনো দেখা যাবে না, যার কোন লাভ এ দুনিয়ায় প্রাপ্তির আশা নেই; আবার এমন কোন কাজ থেকে সংযত হয়ে থাকবে না, যা থেকে এ দুনিয়ার বুকেই কোন ক্ষতি হওয়ার মতো বিপদ সম্ভাবনা না থাকবে। অপরদিকে আর এক ব্যক্তি রয়েছে, যার নযর রয়েছে কাজের শেষ পরিণামের উপর। দুনিয়ার লাভ -ক্ষতিকে সে মনে করে ক্ষণস্থায়ী। সে আখেরাতের স্থায়ী লাভ -ক্ষতি বিবেচনা করেই সৎকর্মের পথ অবলম্বন করবে আর অসৎকর্মের পথ বর্জন করে চলবে, তাতে সৎকর্ম থেকে তার যত বড় ক্ষতিই আসুক আর অসৎকর্ম থেকে যত বেশী লাভের সম্ভাবনাই থাকুক। চিন্তা করা দরকার এদের দু’জনের মধ্যে কত বড় প্রভেদ। একজনের কাছে সৎকাজ হচ্ছে তাই যা সে পাবে পাবে এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে; যেমন কিছু টাকা তার মিলবে, কিছু যমীন তার অধিকারে আসবে, হয়ত কোন পদ সুনাম সুখ্যাতি ও মানুষের বাহবা মিলবে, হয়ত কোন লালসা চরিতার্থ হবে, কিছুটা আকাংখা তার পূর্ণ হবে; হয়ত কিছুটা ভোগের পরিতৃপ্তি সে পাবে? তার ধারণা অনুযায়ী অসৎকাজ হচ্ছে তাই যাতে এ জীবনে কোন খারাপ পরিণাম আসে অথবা আসার ভয় থাকে; যেমন ধন-প্রাণের ক্ষতি, স্বাস্থ্যহানি, সরকার তরফের শাস্তি, কোন রকম দুঃখ কষ্ট অথবা অবাঞ্ছিত অবস্থা। পক্ষান্তরে, অপর ব্যক্তির কাছে সৎকাজ তাই যাতে আল্লাহ খুশী হন, আর অসৎকাজ হচ্ছে তাই যাতে আল্লাহ নারায হন। সৎকাজের ফলে দুনিয়ায় যদি তার কোন লাভ না হয় বরং কোন ক্ষতি হয়, তবুও সে তাকে সৎকাজই মনে করে এবং প্রত্যয় পোষণ করে যে, শেষ পর্যন্ত তার সৎকাজের জন্য চিরদিনের প্রাপ্য লাভ সে আল্লহর কাছে পাবে। অসৎকর্ম থেকে যদি তার কোন ক্ষতি নাও হয়, কোন ক্ষতির ভয় না থাকে বরং তার ফলে কাছে কেবল সুযোগ সুবিধা ই আসতে থাকে, তবুও সে তাকে অসৎকর্মই বলে মনে করে এবং প্রত্যয় পোষণ করে যে, যদি দুনিয়ায় এ সংক্ষিপ্ত জীবনে শাস্তি থেকে বেঁচে যায় এবং কিছু দিন মজা লুটবার সুযোগ পায়; তবু শেষ পর্যন্ত আযাব থেকে তার রেহাই নেই।
এ দু’টি বিভিন্ন ধারণার প্রভাবে মানুষ দু’টি বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে। যে ব্যক্তি আখেরাতের উপর প্রত্যয় পোষণ করে না, তার পক্ষে ইসলামের পথে এক পাও অগ্রসর হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। ইসলাম বলেঃ ‘আল্লাহর পথে গরীবকে যাকাত দাও’। জবাবে সে বলে যাকাত দিতে গেলে আমার সম্পত্তি কমে যাবে। আমার অর্থের উপর আমি সুদ নেব এবং সুদের ডিক্রিতে তাদের ঘরের শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত ক্রোক করে নেব। ইসলাম বলেঃ ‘হামেশা সত্যিকথা বল, আর মিথ্যা থেকে সংযত হয়ে থাক, সত্যভাষণ তোমার যতই ক্ষতি হোক আর মিথ্যা ভাষণে যতই লাভ হোক।’ জবাবে সে বলেঃ এমন সত্যকে গ্রহণ করে আমি কি করব, যাতে আমার কেবল ক্ষতিই হবে, কোন লাভ হবে না? আর এমন মিথ্যা থেকে আমি সংযত হয়ে থাকবো কেন যা আমার জন্য লাভজনক হবে এবং যাতে কোন দুর্নামের ভয় পর্যন্ত নেই? এক নিঃসংগ পথ অতিক্রম করতে করতে তার নযর পড়ছে একটি বহু মূল্যবান বস্তু, অমনি ইসলাম তাকে বলে, ‘এ তোমার সম্পত্তি নয়, কিছুতেই তুমি এ জিনিস গ্রহণ করতে পার না, সে তার জবাব দেয়ঃ আপনা আপনি যে জিনিস আসে তা কেন ছেড়ে দেব। এখানে তো এমন কেউ নেই যে দেখে পুলিশকে খবর দেবে। অথবা আদালতে সাক্ষ্য দেবে অথবা লোকের কাছে আমার বদনাম করবে। এরপর কেন আমি কুড়িয়ে পাওয়া অর্থ থেকে লাভবান হব না? একটি লোক গোপনে তার কাছে কিছু জিনিস আমানত রেখে মারা যায়? ইসলাম তখন তাকে বলেঃ আমানত বিনষ্ট কর না; যার ধন তার সন্তান-সন্তুতি কাছে পৌঁছে দাও। সে বলে উঠেঃ কেন? মৃত ব্যক্তির ধন যে আমার কাছে রয়েছে তার তো কোন সাক্ষী নেই তার সন্তান-সন্তুতি ও এ খবর জানেনা। সহজেই আমি যখন কোন আইনের ভয় না করে কোন বদনামীর আশংকা না করে আত্মসাৎ করতে পারি, তখন কেন তা করব না? সোজা কথায় জীবনের পথে প্রত্যেক পদক্ষেপে ইসলাম তাকে এক বিশেষ পথে চলার নির্দেশ দেবে, আর সে তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথ অনুসরণ করে চলবে। কেননা ইসলামে প্রত্যকটি জিনিসের কদর ও মূল্যমান নির্ধারিত হয় আখেরাতের স্থায়ী ফলাফল বিবেচনায়; কিন্তু সে ব্যক্তি প্রত্যেক ব্যাপারে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এ দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে পাওয়ার মত ফলাফলের উপর। আখেরাতের উপর ঈমান পোষণ ব্যতীত মানুষ যে কেন মুসলমান হতে পারে না, তা এখন সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়। মুসলমান হওয়া তো দূরের কথা প্রকৃতপক্ষে আখেরাতকে অস্বীকার করে মানুষ মুনষ্যত্ব থেকে নেমে গিয়ে পশুত্ব অপেক্ষা নিম্নতর স্তরে চলে যায়।