মানষ কেন ব্যর্থ হয় তার জীবনে?
আপনার এই প্রশ্নের উত্তর আমি সবচেয়ে ভালো দিতে পারবো। কারণ আমি একজন ব্যর্থ মানুষ। এই শহরে আমার মতো ব্যর্থ মানুষ আরেকজন খুজে পাবেন না। জন্ম থেকেই ব্যর্থ আমি। আমার গল্প শুনলেই আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।
আমি লেখাপড়া করি নাই। বন্ধু বান্ধব নিয়ে শুধু আড্ডা দিয়েছি দিনরাত। ঘুরে বেরিয়েছি। কেউ যদি বলতো চল ঘুরে আসি, সাথে সাথে চলে যেতাম। আমার বাপ মা কিছু বলতো না। আমরা অনেক গুলো ভাইবোন, বাবা মা কয়জনের দিকে খেয়াল রাখবে? আমাদের সাথে দুইজন চাচাতো ভাই থাকতো। মার সময় কাটতো রান্না ঘরে। আর আব্বা তো চাকরির খাতিরে ঢাকার বাইরে থাকতো। অবাধ স্বাধীনতা ছিলো আমার। অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে আমি খারাপ হয়ে যাইনি। খারাপ কোনো নেশা আমার নেই। তবে সারারাত জেগে গল্প উপন্যাস পড়তাম। দুপুর পর্যন্ত ঘুমাতাম। ভাইবোনদের সাথে আমার ছোটবেলা থেকেই মিলমিশ কম। ছোটবেলা থেকেই কেমন একটা দূরত্ব। যা আজও অব্যাহত আছে।
আপনি প্রশ্নে একটা ভুল করেছেন। ‘মানুষ’ হবে। আপনি ‘মানষ’ লিখেছেন। জানি ইচ্ছে করে এই ভুল করেন নাই। আমি নিজেও খুব বেশি বানান ভুল করি। যাইহোক, উত্তরটা কোথা থেকে শুরু করবো, কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। কয়েকদিন ধরে মন মেজাজ খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরেছি। আমার রুমমেট রফিক ভাই গ্রামে গেছেন। উনি খুব করে অনুরোধ করেছেন, তার ব্যবসাটা আমাকে দেখতে। মানুষের বিপদে যদি মানুষ হয়ে সহযোগিতা না করি তাহলে কিভাবে হবে!
রফিক ভাই ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন। গেন্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠের সামনে। আমি বিক্রেতা হিসেবে ভালো। দুপুর ১২ টার মধ্যে সব সবজি বিক্রি করে ফেলেছি। আমার চোখে মুখে একটা সহজ সরল এবং সততার ভাবআছে। যে কাস্টমার ফুলকপি একটা কিনবে, সে চারটা ফুলকপি কিনেছে। রফিক ভাই এলে খুশি হবেন। ব্যবসা করতে হয় গায়ের জোর দিয়ে না, সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে। ভালোত্ব দিত। মেধা দিয়ে। ভালোবাসা দিয়ে।
আমরা অনেক গুলো ভাইবোন। সবাই আজ প্রতিষ্ঠিত, শুধু আমি ছাড়া। আমার সেজো বোন ও ছোট বোন দুজনেই অস্টেলিয়া থাকে। তারা স্বামী আর সন্তান নিয়ে ভালো আছে। সুখে আছে। ফেসবুকে তাদের ছবি দেখেছি। শুনলাম দুজনেই নতুন গাড়ি কিনেছে। বাড়ি কিনেছে। গত পাচ বছরে বোনদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। শুনেছি মাঝে দিয়ে একবার দেশে এসেছে। কিন্তু আমাকে ফোন দেয়নি। দেখা করার কথা বলেনি।
আমার মেজো ভাই দেশের সেরা একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন। অনেক টাকা সেলারি। ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার। বড় বড় কাজ করে। ওদের টাকার অভাব নেই। বছরে দুবার ওরা দেশের বাইরে বেড়াতে যায়। গ্রামে পর্যন্ত তিন তলা বাড়ি করেছে। সেই বাড়ি খালি পড়ে আছে। ভাইরা ইচ্ছা করলে আমাকে সেই বাড়িতে থাকতে দিতে পারতো। যেহেতু বাড়িটা খালি পড়ে আছে, তাছাড়া আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। বাড়িতে থাকার বিনিময়ে বাড়ির দেখভাল করতাম।
একবার আমি ছোট ভাইয়ের বাসায় যাই। সেদিন ওদের বাসায় কি যেন একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। ছোট ভাইয়ের বউ বলল, এমন দিনে আসলেন বাসা ভরতি গেস্ট। আমি বললাম, তাহলে আজ যাই। অন্যদিন আসবো। আসলে আমি তোমাদের ছেলেটাকে দেখতে আসছিলাম। ছোট ভাইয়ের বউ বলল, ছোটন ওর বন্ধুদের সাথে খেলছে, এখন আসবে না। আমি চলে আসছিলাম, তখন ছোট ভাইয়ের বউ বলল, দাড়ান। আমি দাড়ালাম। ছোট ভাইয়ের বউ আমাকে দুটা পুরান শার্ট দিলো। একটা ছেড়া লুঙ্গি দিলো এবং হাতে কিছু টাকা গুজে দিলো। সব মিলিয়ে ৭৭ টাকা। আমার খুব অপমান লাগলো, কষ্ট লাগলো। চোখে একদম পানি চলে আসছে। ছোট ভাইয়ের বাসায় আমি কি পুরনো শার্ট প্যান্ট আনতে গেছি?
বাবার মৃত্যুর পর আমি শালা পড়ে গেলাম গর্তে। ভয়াবহ গর্তে। এখন থাকি একটা মেসে। ভয়াবহ অবস্থা। জঘন্য সেই মেস। এক রুমে থাকি আমরা আট জন। আমার রুমমেটরা ব্যবসায়ী। একজন রাস্তায় সবজি বিক্রি করে। একজন এটিএম বুথের সিকিউরিটি গার্ড। একজন কাওরানবাজারে এক রেস্টুরেন্টের মেসিয়ার। সুমন ভাই সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছেন, উনি এক অফিসের কেরানি। এদের মধ্যে আমার অবস্থা সবচেয়ে করুন। আমি কিছুই করি না। কি করবো? কোনো কাজই তো পারি না। সফটওয়্যারের কাজ জানলে ভালো হতো।
আমার রুমমেটরা ভালো। মেসের ভাড়া দিতে পারি না, খাওয়ার খরচ দিতে পারি না, তবুও ওরা আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় না। বরং সিগারেট খেতে দেয়। সারাদিন আমি একদম ফ্রি থাকি না। ওদের জন্য রান্না করি। রান্নার কিছুই জানি না। কিন্তু ওরা খেয়ে বলে দারুণ হইছে। আমি লাইব্রেরি থেকে বই আনি। বই পড়ি। বই পড়তে আমার ভালো লাগে। অবশ্য সিনেমাও দেখতে আমি পছন্দ করি কিন্তু ল্যাপটপ না থাকায় মুভি দেখা হয় না। শেষ সিনেমা দেখলাম, ফরেস্ট গাম্প আর লাইফ ইজ বিউটিফুল। এই মুভিটা দেখে শেষের দিকে চোখে পানি চলে আসছে। চিলড্রেনস অব হেভেন মুভিটা দেখেও চোখে পানি এসেছিলো।
আমি লেখাপড়া করি নাই। লেখাপড়ায় আমার মন ছিলো না। ক্লাশে আমি জানালার কাছে বসতাম, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বড় ভালো লাগতো। বছর শেষে ফেল করতাম। আমার ছোট মামা আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। ফেল করার পরও তিনি আমাকে সাপোর্ট করতেন। আমাকে নিয়ে ভোলা ভাইয়ের বিরানীর দোকানে যেতেন। বলতেন, কি খাবি, খা। খাওয়া শেষে মামা একটা কোক কিনে দিতেন।
এই মামাই আমাকে এক অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। সেই অফিসে আমি জান জীবন দিয়ে খেটেছি। যে যা বলতো করে দিতাম। এমন কি অফিসের কেউ বাসা বদল করলে, আমাকে ডাক দিতো। একদিন অফিসের ম্যানেজার আমাকে ডেকে নিলেন। আমি মালপত্র ঠেলা গাড়িতে নিতাম, ঠেলাওলাদের সাথে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে নতুন বাসায় নিয়ে যেতাম। খাট আলমারি ওয়ার্ডরোব নিচ তলা থেকে পাচ তলায় নিয়ে যেতাম। কাজ শেষ করার পর ম্যানেজার বললেন, একদিন সময় করে এসে আমার বাসায় খেয়ে যেও। তোমার দাওয়াত রইলো।
সারা রাত শরীর ব্যথায় ঘুমাতে পারতাম না। জ্বর এসে যেতো। মাথায় পানি দেওয়া কেউ নেই। কেউ কেউ আমাকে দিয়ে বাজার করাতো। অফিস ছুটি ছয় টায়, কিন্তু আমি বাসায় ফিরতাম তার ১১ টায়। প্রতিদিনই কারো না কারো কাজ থাকতো। আমার সব সময় মানুষজন নিয়ে নিতো। দু:খে কষ্টে জীবনটা পার হয়ে যাচ্ছে। একটু সুখ আর আনন্দ পেলাম না। টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনে পড়ার অবস্থা নেই। রাস্তায় দেয়ালে লাগানো মানহীন দৈনিক পত্রিকা গুলো পড়ি। ঘুম পেলে মসজিদে ঘুমাই। গুলশান মসজিদে প্রায়ই দুপুর বেলা তবারক দেয়। এজন্য আমি গুলশান মসজিদে যাই। দুপুর টাইমে মিষ্টি, ছানা দেয় না। তেহারি বা খিচুড়ি দেয়। সেই সব তেহারি আর খিচুড়ি খেয়েছি দীর্ঘদিন।
অফিসে সবাই আমাকে ভালোবাসে। অফিসে বসের স্ত্রী আমাকে নিয়ে নিউ মার্কেটের কাচা বাজার যায়। আমি বাজারের ব্যাগ নিয়ে বসের স্ত্রীর পেছন পেছন ঘুরি। নিউ মার্কেট থেকে বসের বউ মিরপুর এক পার্লারে যায়। আমি পার্লারের নিচে বসে থাকি। বিনিময়ে বসের স্ত্রী আমাকে পুরোনো জামা জুতো দেয়। যেদিন খুব বেশি খাটায়, আমাকে সেদিন খেতে দিতো। ফ্রিজের বাসী ভাত তরকারি। বাসী সেটা কোনো ব্যাপার না। যদি একটু ওভেনে গরম করে দিতো, আরাম করে খেতে পারতাম।
বসের বউটা খুব অমানবিক ছিলেন। একবার সন্ধ্যায় তিনি আমাকে ফোন করে আসতে বললেন। আমি জ্যাম পার হয়ে, অনেকটা পথ হেটে মগবাজার থেকে গুলশান যাই ম্যাডামের বাসায়। ম্যাডাম বললেন, তোমাকে কেন ডেকেছি, ভুলে গেছি। যাইহোক, তুমি এসেছো যখন আমাকে এক পাতা নাপা আর এক পাতা সারজেল ওষুধ এনে দাও। ম্যাডামের বাসার আশেপাশে কোনো ফার্মেসী নেই। আমি হাটতে হাটতে গুলশান দুই নম্বর যাই। সেখান থেকে ওষুধ কিনে ম্যাডামকে দিয়ে রাত ১১ টায় আমি বাসায় ফিরি। ক্লান্ত বিধস্ত।
ওই অফিসে আমি সাত বছর চাকরি করেছি। মজার ব্যাপার হলো সাত বছরে সাত দিন ছুটি নিইনি। এমনকি আমার কোনো অসুখ বিসুখও হয়নি। আরো মজার ব্যাপার হলো- প্রতিদিন সকাল নয়টার মধ্যে অফিসে ঢুকতাম। কখনো লেট করিনি। আফসোস এজন্য কেউ আমাকে কোনোদিন বাহবা দেননি। অফিসের এক বড় ভাই ছিলো, হারামজা আমাকে খাটাতে খাটাতে জীবনটা কয়লা করে দিছে।
একদিন কোনো কারন ছাড়াই হঠাৎ আমার চাকরি চলে গেলো। মনে মনে আমি খুশিই হলাম। যাক এবার বিশ্রাম পাবো। বিশ্রামের দরকার আছে। জমানো টাকা দিয়ে একটা এসএলআর ক্যামেরা কিনলাম। সারাদিন ক্যামেরা কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। ছবি তোলার ভালো কোনো বিষয় পেলে ছবি তুললাম। ছবি তোলার পাশাপাশি একটা উপন্যাসের কাজে হাত দিলাম। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস। বিশাল এক উপন্যাস। সেই উপন্যাস আজও শেষ করতে পারিনি। জন্মগত পোড়া কপাল আমার।
দু:খজনক কথা হলো, মামার দেওয়া চাকরির পর, আমি আর কোনো চাকরি পাইনি। সেই থেকে আমার বেকার জীবন শুরু। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং ভাই বোনেরা আমাকে ত্যাগ করলো। একের পর এক আঘাত পেতে পেতে আমি মানসিক ভাবে বিধস্ত হয়ে পড়লাম। আমার ওজন কমে গেলো, চোখে মুখে বয়সের ছাপ পড়লো। দারুণ অভাবে পড়লাম। থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাবা মাও বেচে নেই। বন্ধুর অফিসে গেলে, বন্ধু দেখা করে না। পিয়ন দিয়ে খবর পাঠায় মিটিংয়ে আছে। মিটিং শেষ হতে দেরী হবে।
ভাইয়ের বাসায় গেলাম। হাজার হোক, আপন ভাই। মায়ের পেটের ভাই। কথায় আছে, মার পেটের ভাই, কোথায় গেলে পাই। ক্ষুধা আর অভাব সহ্য করতে না পেরে একদিন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। ভাই কোনো কথাই বলল না আমার সাথে। তার নাকি প্রেসার বেড়েছে। ফিরে এলাম। পরের দিন ভাবী ফোন করে বললেন, তোমার ভাইয়ের হাত ঘড়িটা আমি মনের ভুলে নিয়ে এসেছি কিনা। ঘড়ি তার শ্বশুর দিয়েছিল বিয়ের সময়। ঘড়িটা ভাইয়ের খুব পছন্দ। আমি দরিএহতে পারি, কিন্তু আমি মানুষটা সৎ। যাইহোক, ভাবীর কথা শুধু আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম। ভীষণ মন খারাপ হলো।
বিয়ে করেছি। আমার এক ছেলে আছে। অভাবের কারণে আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে যায়। পাচ বছর হয়ে গেলো! এই পাচ বছরে একবারও সুমির সাথে দেখা হয়নি। আমার বাচ্চাটাকে দেখি নাই। জানি না তারা কোথায় আছে। কেমন আছে! বাচ্চাটার জন্য বড় কষ্ট হয়। সুমির কোনো দোষ নাই। সুমি ভালো মেয়ে। সুমির বাবা বিরাট বদ লোক। এই শালারে রাস্তায় পেলে দূর থেকে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব।
আজ যদি আমি ভালো ভাবে লেখাপড়া করতাম, তাহলে ডাক্তার হতাম। অথবা পাইলট। নিদেনপক্ষে একজন ব্যাংকার তো হতাম। লেখাপড়া না করার কারনে আজ আমি অন্যের সবজি বিক্রি করে দেই। আমি শালা নির্বোধ। গাধা। একজন ব্যর্থ মানুষ। কিছুই পারি না। গাড়ি চালাতে পারি না, রিকশা চালাতে পারি না। কম্পিউটারের কোনো কাজই পারি না। প্রচন্ড ভীতু আমি। মানুষের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে পারি না। সেদিন এক রিকশা চালক আমার কলার চেপে ধরেছে। আমি শালা মরিও না। কত মানুষের মৃত্যু হয়। আমার মৃত্যু হয় না। আল্লাহ যেহেতু আমাকে বাচিয়ে রেখেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা আমাকে নিয়ে আরো কিছু পরিকল্পনা আছে।