হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কতটুকু বিজ্ঞান সম্মত?
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কতটুকু বিজ্ঞান সম্মত?
গত কয়েক বছর ধরে গোটা বিশ্বের অ্যালোপ্যাথিক লবির বৈজ্ঞানিক এবং বিশেষজ্ঞরা হোমিওপ্যাথির সমালোচনা করে চলেছেন ৷ গত সপ্তাহেই তো ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাশোসিয়েশন একে ‘ডাইনিবিদ্যা’ নাম দিয়েছে ! একে অবৈজ্ঞানিক বলে তারা ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্হ্য পরিষেবাকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাধীন ব্যত্তিদের চিকিৎসার খরচ বহন না করতে অনুরোধ জানিয়েছে ৷ অ্যালোপ্যাথিক লবি এর আগেও বহুবার হোমিওপ্যাথির বৈজ্ঞানিক গুরুত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তার সমালোচনা করেছে ৷ 2005 সালের 27 আগস্ট ‘দ্য ল্যান্সেট’ নামক ব্রিটেনের এক পত্রিকায় ‘দ্য এন্ড অফ হোমিওপ্যাথি’ শীর্ষক একটা বিতর্কিত নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল ৷ তাতে দাবি করা হয়েছিল, হোমিওপ্যাথির নাকি শুশ্রূষাগত কোনও ক্ষমতা নেই৷ বিশ্বের বিভিন্ন চিকিৎসক এবং গবেষকরা ওই নিবন্ধের সমালোচনা করেছিলেন ৷ লোকে বলে, বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থা হোমিওপ্যাথিকে বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্হা বলে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ কিন্তু অ্যালোপ্যাথিক লবির চাপে তারা সেটা এখনও ঘোষণা করেনি ৷
অ্যালোপ্যাথির ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান রোগ, জটিলতা এবং নিরাময়ে ব্যর্থতার ফলে ক্রমশ হোমিওপ্যাথির মতো বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্হাগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করছে ৷ আগে তো অ্যালোপ্যাথিকের বিখ্যাত ডাক্তারও হোমিওপ্যাথিকে সম্বল করে নানা সময় চিকিৎসার কাজ করেছেন ৷ অ্যালোপ্যাথির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে লোকজন আজ খুবই বিরক্ত ৷ লন্ডন হাসপাতালের বিখ্যাত ডাক্তার ডঃ পিটার ফিসার বলেন যে, লন্ডনের বুকে হোমিওপ্যাথির জনপ্রিয়তা দুরন্ত গতিতে বাড়ছে ৷ হোমিওপ্যাথিক হাসপাতালগুলোর জন্য ব্রিটিশ সরকার বছরে এখন চার মিলিয়ন পাউন্ড করে খরচ করে৷
আবু-ধাবি, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, বেলজিয়াম, চিলি, সাইপ্রাস, কানাডা, কোস্টারিকা,ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মিশর, ফিজি, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, জার্নি, গায়না, হল্যান্ড, হাঙ্গেরি,আয়ারল্যান্ড, ইজরায়েল, ইতালি, ভারত, জাপান, কেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, মেক্সিকো, মরিশাস,মালেশিয়া, নাইজিরিয়া, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, পর্তুগাল, পানামা, ফিলিপিন্স, কাতার,রাশিয়া, রোমানিয়া, সু্যইজারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, স্কটল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, স্পেন, তাইওয়ান, ব্রিটেন এবং ইউক্রেনের মতো দেশে হোমিওপ্যাথি যথেষ্ট জনপ্রিয় ৷ বিখ্যাত ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক এবং বিশেষজ্ঞ ডঃ মাইকেল ব্রুক্সের মতে, ফ্রান্সের 40 শতাংশ চিকিৎসক হোমিওপ্যাথি ব্যবহার করেন৷ ব্রিটেনে 37 শতাংশ এবং জার্নির 20 শতাংশ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক নিজেদের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির ব্যবহার করেন ৷ 1999 সালে চালানো এক সমীক্ষা অনুযায়ী, হোমিপ্যাথির জন্য কোনও বিমা পরিষেবা না থাকা সত্ত্বেও আমেরিকার 60 মিলিয়ন মানুষ তখন হোমিওপ্যাথি ব্যবহার করত৷ তাদের সংখ্যা এখন আরও অনেক বেড়ে গেছে৷
লাভাঙ্কের দিক থেকে চিকিৎসা এবং ওষুধ ব্যবসার এখন সুবর্ণ যুগ চলছে ৷ স্বাস্হ্য পরিষেবা ইন্ডাস্ট্রি এখন বছরে 13 শতাংশ হারে বাড়ছে এবং এটা এখন এক অত্যন্ত লাভজনক ইন্ডাস্ট্রি ৷ কিন্তু ব্যবসার নেশায় মত্ত এই ইন্ডাস্ট্রি রোগিদের চিকিৎসার থেকে বেশি গুরুত্ব দিচেছ আর্থিক লাভাঙ্ককে ৷ আমেরিকার মতো দেশে চিকিৎসা এবং ওষুধ মারাত্মকভাবে ব্যয়বহুল বলে 30 থেকে 40 শতাংশ মানুষ তো উপযুক্ত চিকিৎসাই পান না ৷ সম্প্রতি মার্কিন হাউস নতুন একটা স্বাস্হ্য বিল পাস করেছে ৷ এতদিন ধরে স্বাস্হ্য বিমার বাইরে থাকা নাগরিকদের বিমার আওতায় আনার জন্যই তাদের এই উদ্যোগ ৷ কিন্তু মার্কিন যুত্তুরাষ্ট্রের অভিজাত লবি সেই বিলের তুমুল সমালোচনা করেছে৷ এরকম এক অবস্হায় যখন নিজেকে সম্বল করে হোমিওপ্যাথি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করছে, তখন অ্যালোপ্যাথি লবি তাকে ধবংস করার চেষ্টা করছে! 1854 সালে লন্ডনে কলেরার মহামারী দেখা দিয়েছিল ৷ তখন অ্যালোপ্যাথি ব্যবহারকারী রোগিদের মৃত্যুর হার ছিল 53.2 শতাংশ, অথচ হোমিওপ্যাথি ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ওই হার ছিল মাত্র 24.4 শতাংশ ! 1892 সালে জার্নির হামবুর্গে যে মহামারি দেখা দিয়েছিল, সেক্ষেত্রেও সমান পারদর্শিতার প্রমাণ রাখে হোমিওপ্যাথি ৷ 1962-64 সালে নিউ ইয়র্কে মহামারী রোধের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিল ৷ আর 1918 সালে গোটা বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারী প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির ভূমিকা কে ভুলতে পারে ?
জটিল এবং দূরারোগ্য রোগে ভুগতে থাকা রোগীদের জীবনে সত্যিকারের ত্রাতার ভূমিকা নিতে পারে হোমিওপ্যাথি ৷ এর কল্যাণে বহু মানুষ নতুনভাবে নিজেদের জীবন শুরু করতে পেরেছে ৷ চর্মরোগ, যৌনরোগ, বাত, ক্যানসার, টিউমার, পেটের রোগ এবং শিশু ও মায়েদের বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি খুবই কার্যকর ৷ যথেষ্ট ভরসাযোগ্য ফলাফল দেখানো সত্ত্বেও অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা হোমিওপ্যাথিকে উপযুক্ত সম্মান দিতে নারাজ ৷ কারণ, অ্যালোপ্যাথি লবি যথেষ্ট অনিশ্চয়তায় ভুগছে৷ তাদের আশঙ্কা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগতে থাকা অ্যালোপ্যাথিক রোগিরা যদি হোমিওপ্যাথির দিকে পা বাড়ায়, তাহলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷
সবাই জানে যে, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সামনে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো ক্রমশ বাড়ছে ৷ পাশাপাশি প্লেগ, সার্স, ম্যালেরিয়া, টিবি, ডায়োরিয়া ও ফ্লুর মতো রোগগুলোর ক্ষেত্রে অ্যালোপ্যাথি ব্যর্থ হচেছ ৷ ম্যালেরিয়া এখন যথেষ্ট মারাত্মক, টিবির ওষুধ তো কাজই করে না, আর ফ্লু-র ভাইরাসকে মারার ক্ষমতা হারিয়েছে তার ওষুধগুলো ৷ মানুষের পক্ষে আর অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া সম্ভব হচেছ না ৷ এমতাবস্হায় খুবই উপযোগী বিকল্প চিকিৎসার ভূমিকা নিতে পারে হোমিওপ্যাথি ৷ তা সত্ত্বেও সরকারি স্বাস্হ্য ব্যবস্হার পরিচালনা এবং পরিকল্পনার সময় এখনও হোমিওপ্যাথিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচেছ না ৷ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ ও মহামারী প্রতিরোধের জন্য হোমিওপ্যাথিতে অনেক ধরনের ওষুধ আছে৷ তাই এই চিকিৎসা ব্যবস্হাকে স্বাগত জানানোর সময় এসে গেছে ৷ সম্প্রতি কলকাতার সুকল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সাহায্যকে সম্বল করে জাপানিজ এনসেফেলাইটিসের নতুন ওষুধ আবিষ্কার করেছে সেন্টাল সুকল অফ হোমিওপ্যাথিক রিসার্চ কাউন্সিল ৷ আমেরিকার জার্ল অফ ইনফেক্সাস ডিজিজেস-এ তা প্রকাশিতও হয়েছিল ৷
লিখেছেন :
প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ ড.এ.কে.অরুণ,এম. ডি (হোমিও)
প্রকাশিত : দ্যা সানডে ইন্ডিয়ান