অটিস্টিক শিশুর বৈশিষ্ট্য কী?

অটিস্টিক শিশুর বৈশিষ্ট্য কী?
Add Comment
1 Answer(s)

    অটিস্টিক বা অটিজম-আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে সাধারণত তিন বছর বয়সের মাঝেই অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে, শিশু আরেকটু বড় না হওয়া পর্যন্ত রোগ সঠিকভাবে নিরূপন করা যায় না। অটিজম-আক্রান্ত শিশুর বিকাশের তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এগুলো হচ্ছে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া, যোগাযোগ এবং আচরণ ও আগ্রহ।

    সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া:

    অটিস্টিক শিশুরা সামাজিক সম্পর্ক তৈরী করতে ব্যর্থ হয়। স্বাভাবিক একটি শিশু বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় মা-বাবা, নিকটজন বা পরবর্তীতে অন্যদের সাথে যেভাবে সামাজিক সম্পর্ক তৈরী করে, অটিস্টিক শিশু তা করতে পারে না। স্বাভাবিক শিশু বৃদ্ধির সাথে সাথে বাবা-মার চোখে চোখ রেখে হাসে, চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি দিয়ে মাকে অনুসরণ করে, কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়ায়। অটিস্টিক শিশুরা বাবা-মা বা পরিচর্যাকারীর চোখে চোখ রেখে তাকায় না, মুখভঙ্গি বা শারীরিক অভিব্যক্তির মাধ্যমেও সে তার প্রতি অন্যদের সামাজিক আচরণের প্রত্যুত্তর দিতে পারে না। নিজের নাম বোঝার বয়সে এসব শিশুকে নাম ধরে ডাকা হলেও সে সাড়া দেয় না, এমনকি ফিরেও তাকায় না। সমবয়সী শিশুদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে না, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ব্যাপারটাই সে বোঝে না। অন্য শিশুদের মাঝে রাখা হলেও সে একপাশে সরে যায় অথবা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কাউকে শারীরিক আঘাত করে বসে। অন্যদের ব্যাপারে সে কোন আগ্রহ বোধ করে না। সে আপনমনে থাকতে পছন্দ করে। দেখে মনে হয়, সে যেন একাকী, আলাদা, নিজস্ব জগতে বাস করে, যে জগতের সাথে অন্য কারো কোন সম্পর্ক নেই। কোন ধরণের আনন্দদায়ী বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সাথে শেয়ার করতে জানে না। সাধারণত শিশু নতুন বা আকর্ষক কোন খেলনা হাতে পেলে বা তার জন্য উদ্দীপক কোন বস্তু বা বিষয় দেখতে পেলে অন্যদের দৃষ্টি সেই খেলনা, বস্তু বা বিষয়ের দিকে আকর্ষণ করে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুদের বেলায় এসব বিষয়ে নিজস্ব আগ্রহ কখনো তৈরী হলেও এ নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায় না। কোলে নেয়া বা আদর করা তারা পছন্দ করে না। কেউ আদর করতে গেলে হয় নিষ্পৃহ থাকে অথবা চিৎকার-কান্নাসহ অস্বাভাবিক আচরণ করে। বেশীরভাগ শিশু পারিবারিক পরিমন্ডলে ‘অমিশুক’ বলে চিহ্নিত হয় রোগ ধরা পড়ার আগেই।

    যোগাযোগঃ

    ভাষা অথবা অভিব্যক্তির মাধ্যমে অন্যের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুদের দক্ষতার কমতি দেখা যায়। বিকাশের সাথে সাথে শিশুর ভাষা শিক্ষা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অটিজম-আক্রান্ত অনেক শিশু ভাষা শিখতে ব্যর্থ হয়। দেখা যায়, ২ বা ৩ বছর বয়সী শিশুরা যে সব শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, সমবয়সী অটিস্টিক শিশুরা তা পারে না। বাকযন্ত্রের গঠন, জিভ-তালু, ধ্বনির উচ্চারণে কোন সমস্যা না থাকলেও এবং শিশুর সাথে নিয়মিত কথা বলা হলেও অটিস্টিক শিশু অনেক সময় কথা শিখতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শব্দ ভান্ডার হয়তো ঠিকই থাকে, কিন্তু বাক্য শুরু করতে অস্বাভাবিক দেরী হয়। অথবা বাক্য শুরু করলেও কথা চালিয়ে যেতে পারে না বা যথাযথভাবে তা শেষ করতে পারে না। অনেকের সর্বনাম ব্যবহারে অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। ‘আমি’-এর জায়গায় ‘তুমি’ বলে। যেমন, নিজের কোন প্রয়োজনে ‘আমি চাই’ না বলে ‘তুমি চাও’ – এভাবে বলে। অনেকে অপ্রাসংগিকভাবে অর্থবোধক বা নিরর্থক শব্দ বা বাক্যাংশ বার বার উচ্চারণ করে। তিন বছর বা তার কম বয়সী স্বাভাবিক শিশুরা তাদের বয়সোপযোগী নানা ধরণের কল্পনাশ্রয়ী ও গঠনমূলক খেলা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তৈরী করে। যেমন, পুতুল হাতে পেলে পুতুলকে খাওয়ানো, কাপড় পরানো বা খেলনা গাড়ি চালানোর ভান করা ইত্যাদি। অটিস্টিক শিশুরা খেলনা হাতে পেলেও এরকম উদ্ভাবনী কোন দক্ষতা দেখাতে পারে না।

    আচরণ ও আগ্রহ:

    অটিস্টিক শিশু অহেতুক বা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে একই আচরণ বার বার করতে থাকে। যেমন, মাথা সামনে-পেছনে দোলাতে বা হাততালি দিতে থাকে। এদের আচরণ ও কাজকর্ম সীমিত বা গন্ডিবদ্ধ। অনেকে সব কিছু রুটিনমাফিক বা একইরকমভাবে করতে পছন্দ করে। এর ব্যত্যয় হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন, সকালে নিয়মিত গোসলের অভ্যাস করানো হলে কোনদিন যদি তা না করানো হয় বা দেরী হয় তাহলে সে অস্বাভাবিক ও দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। আবার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বা অবস্থার পরিবর্তনও সে সহ্য করতে পারে না। ঘরের আসবাব যেরকম ভাবে ছিল, তার পরিবর্তনেও শিশু বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়, চিৎকার করে বা কাঁদে। এর মানে অবশ্য এই নয়, যে তারা খুব শৃংখলাপূর্ণ জীবনযাপন করে। এই রুটিন অনাবশ্যক এবং অপ্রয়োজনীয় হলেও তারা এর বাইরে যেতে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বিশেষ কোন খেলনা বা বস্তু বা কাজের প্রতি এদের অতিরিক্ত মোহ দেখা যায়। যেমন, কোন নির্দিষ্ট খেলনা গাড়ি পছন্দ হলে সেটা নিয়েই সব সময় খেলা করে। নতুন এবং আগের চেয়ে ভালো কোন খেলনা গাড়ি দিলেও সে পুরনোটিই আঁকড়ে থাকে। অনেকে আবার খেলনার চেয়ে খেলনার নির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়েই মেতে থাকে। যেমন, খেলনা পুতুল নিয়ে পুতুলের মতো না খেলে এর একটি হাত নিয়েই কেবল নাড়াচাড়া করতে থাকে। অনেকে দোলনা বা রকিং চেয়ার বা একই স্থানে দাঁড়িয়ে ঘুরতে থাকা- এ জাতীয় পুনরাবৃত্তিমূলক খেলা পছন্দ করে।

    এছাড়াও অটিস্টিক শিশুদের মাঝে আরো নানা ধরণের উপসর্গ-লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অনেক অটিস্টিক শিশু আওয়াজ পছন্দ করে না। উচ্চস্বরে কথা বা গান শুনলে তারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। অনেকে আবার নির্দিষ্ট কোন ধরণের শব্দ, যেমন , ঘড়ির টিক টিক শব্দ বা ফ্যান ঘোরার আওয়াজ প্রভৃতিতে অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক দীর্ঘস্থায়ী আগ্রহ দেখায়। অনেকের ব্যথার অনুভূতি কমে যায়, আবার কেউ কেউ একটুতেই অস্বাভাবিক বেশী ব্যথার প্রতিক্রিয়া দেখায়। কোনো কোনো অটিস্টিক শিশু আপাতদৃষ্টিতে কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রেগে যায় বা ভয় পায়। অটিজম-আক্রান্ত সকল শিশুই বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী নয়, তবে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুর বুদ্ধি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কিছুটা কম হয়। ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশের বৃদ্ধিবৃত্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকে। আবার, কিছু অটিস্টিক শিশুর বিশেষ কোন বিষয়ে, যেমন, সংগীত, ছবি আঁকা, আবৃত্তি প্রভৃতিতে এমন পারদর্শিতা দেখা যায়, যা তার বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক। অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে ২৫ শতাংশের খিঁচুনী থাকতে পারে।

    এসব লক্ষণের যে কোনটি সাময়িক সময়ের জন্য যে কোন স্বাভাবিক শিশুর মাঝেই দেখা দিতে পারে। তাই, দু-একটি লক্ষণ দেখেই শিশুকে অটিস্টিক ভাবা ঠিক নয়। অথবা সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায় অদক্ষতা, যোগাযোগে ব্যর্থতা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ ও আগ্রহ- এই তিন বিষয়ের যে কোন একটি থাকা মানেই অটিজম নয়। এই তিন ক্ষেত্রের প্রতিটিরই কম-বেশী লক্ষণ দেখা দিলে তবেই শিশুটিকে অটিস্টিক বলে ভাবা যেতে পারে। তবে, শিশু অটিজম-আক্রান্ত কি না- এ ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত দেবেন অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বই বা পত্রিকা পড়ে কিংবা ইন্টারনেট ঘেঁটে উপসর্গ মিলিয়ে ঘরে বসে শিশুকে অটিস্টিক ভেবে নেয়া উচিত নয়। তাই, লক্ষণ দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

    অটিজম সম্পর্কে সারা বিশ্বে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২ এপ্রিল ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এ বছর চতুর্থবারের মতো এ দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল – ‘অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী উন্নয়নে পণবন্দী’। (সংগৃহীত)

    Professor Answered on June 8, 2015.
    Add Comment
  • RELATED QUESTIONS

  • POPULAR QUESTIONS

  • LATEST QUESTIONS

  • Your Answer

    By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.