আপনার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কী?

    আপনার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কী?

    Default Asked on March 19, 2024 in অনুসরণ.
    Add Comment
    1 Answer(s)

      ভয়ংকর বলতে ঠিক যা বোঝায় আমার অভিজ্ঞতা হয়ত সেই রকম নয়। তবে আমার আজ পর্যন্ত জীবনের খারাপ বা মনে পড়লে ভয় পাওয়ার মত ঘটনা অবশ্যই।

      তখন আমার ৬ বছর বয়েস, দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্রী। জামশেদপুরের ডিসেম্বর মাসের এক সকাল। সেই সময় শীতকালে সব বাড়িতেই বাচ্চাদের সকালবেলা এক পেট খাইয়ে বাইরে রোদ্দুরে খেলতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এই ফাঁকে মায়েরা বাড়ির কাজ গুছিয়ে নিতেন। বাচ্চারাও একচোট খেলাধুলা করে দুপুরে বাড়িতে ফিরত। আমরাও দু’ভাই-বোন ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমি ৬ আর ভাই ১ বছর, সবে টলমলে পায়ে হাঁটতে শিখেছে। সেদিনও রোজের মত আমরা খেয়েদেয়ে সাজুগুজু করে বের হলাম। আমার সাজের একটু বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন এখানে। এমনিতে স্কুল খোলা থাকলে আমি নিরাভরণ থাকতাম। কিন্তু ছুটির সময় মা আমায় সালঙ্কারা করে দিতেন। সেদিন তাই কানে সোনার দুল, গলায় লাল পাথরের লকেট সমেত সোনার হার, হাতে সোনার আংটি ও দু’হাতে চুরি এবং পায়ে রূপোর নুপুর ছিল।

      কোনও কারণে সেদিন সকালে আমরা দুজন একটু আগে বেড়িয়ে পড়েছিলাম।আর কোনও বাচ্চা বের হয়নি। আমি ভাইয়ের হাত ধরে বাড়ির সামনের মাঠে পাড়ার বড় বড় দাদাদের ভলিবল খেলা দেখছি।কেউ আসছেনা দেখে ইচ্ছা হল একটু এগিয়ে দেখি আমার বন্ধুরা কোথায়। তাই ভাইকে নিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে দু’পা এগিয়ে গেছি।

      হঠাৎ সাইকেলে চেপে একজন এসে রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন। গোলাপি জামা, কালো প্যান্ট, অপরিচিত। বললেন – ” আমি তোমার বাবার বন্ধু। একই অফিসে কাজ করি। আমি অফিস যাবো। বাড়ি থেকে টিফিন আনতে ভুলে গেছি। তুমি একটু যাবে আমার সাথে? “

      আমিঃ কেন? আমি যাবো কেন?

      গোলাপি জামাঃ আমি টিফিন আনতে গেলে আমার সাইকেলটা কেউ নিয়ে যেতে পারে। তুমি একটু পাহারা দেবে।

      আমিঃ তাহলে ভাইকে বাড়িতে ছেড়ে আসি তারপর যাব।

      গোলাপি জামাঃ নানা ওকে এখানে ছেড়ে দাও। নাহলে আমার অফিসে দেরি হয়ে যাবে।

      আমিঃ কোথায় যেতে হবে? মা জানতে পারলে বকবে।

      গোলাপি জামাঃ এই তো কাছে। যাব আর আসব।

      আমি আমার মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত বাচ্চা। “সর্বদা অন্যের উপকার করিবে” — মাতৃবাণী স্মরণ করে ভাইকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাইকেলে উঠে বসলাম। তিনিও আমাকে নিয়ে চললেন। যেতে যেতে দেখি তিনি ক্রমশ আমার বাবার অফিসের দিকেই যাচ্ছেন। ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হল। মাকে বোঝানো যায়, কিন্তু বাবা যদি দেখতে পান যে সাইকেল চেপে ভ্রমণরত আর জীবনেও বাড়ি থেকে বেরনো হবেনা। জিজ্ঞাসা করলাম ” কোথায় যাচ্ছেন? আর কতদুর?” কারণ তখন বেশ অনেকটা চলে এসেছি বাড়ি থেকে। তিনি আঙ্গুল তুলে অনেক দুরের একটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন ” ওই বাড়িটা। ” এবার কেঁদে ফেললাম। কারণ দুটো ভয়। এক বাবা দেখতে পারেন। দুই ভাইকে ছেড়ে এসেছি, যদি পড়ে যায় বা বাড়ি না পৌঁছায় !” জোর করতে লাগলাম ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি শুনলেন না। আমি হাত দিয়ে সাইকেলের হাতলের ব্রেক চেপে ধরতে চাইলাম। তিনি হাত আটকে রাখলেন। হঠাৎ সাইকেলের চেন খুলে গেল। সাইকেল থামাতে বাধ্য হলেন। আমিও লাফ দিয়ে নেমে ” আমি যাই” বলে উল্টোদিকে হাঁটতে লাগলাম। তিনি বাধা দিলেন, বক্তব্য “এতো রাস্তা হাঁটবে কেন? আমি ছেড়ে আসব। “

      আমি তখন ছুটতে শুরু করেছি। কোনও দরকার নেই সাইকেল ভ্রমণের।চটি পায়ে হোঁচট খেতে লাগলাম। পিছন ঘুরে দেখি সাইকেল আসছে।এবার অজানা আশঙ্কায় মন ভরে গেল।বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ল, কদিন আগেই বাবা বলেছিলেন কিছু বাচ্চা তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ছেলেধরা।

      আমি চটি হাতে নিয়ে প্রানপনে দৌড়াতে লাগলাম। রাস্তায় আমার বন্ধুর সাথে দেখা। দেখেই বলল – ” কোথায় ছিলি? কাকিমা খুঁজছে কখন থেকে।” আমি আরও ভয়ে দৌড় দিলাম। বাড়ি গিয়ে দেখি মা ভাইকে কোলে নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে। আমি কেঁদে ঘেমে নেয়ে একসা তখন। আমাকে দেখেই মা খারাপ ঘটনার আভাস পেলেন, সব শুনেই আগে গা থেকে গয়না খুলতে লাগলেন। আমি দেখলাম ” গোলাপি জামা” সামনের মাঠে এসে দাঁড়িয়ে ভলিবল খেলা দেখছে। মাকে দেখালাম। মা সাথে সাথে সামনের মাঠের দাদাদের ডেকে সব বললেন। কিন্তু ততক্ষনে “গোলাপি জামা” উধাও।

      বাবাকে ফোন করে ডাকা হল।এসে সব শুনে যা বোঝার বুঝলেন। মাকে মৃদু ধমক দিলেন গয়নার জন্য।শীতের সকালের রোদ্দুর খাওয়ার আরামটা আমার মাটিতে মিশল। আমি গৃহবন্দী হলাম। কারণ চেনাজানা সবাই বললেন আবার বেরোলে যদি আবার তুলে নিয়ে যায়। অগত্যা …

      ছোট জায়গা, কথা রাষ্ট্র হতে সময় লাগল না। স্কুল খুললে সবাইকে জানানো হল। স্কুলে নিয়ম হল কোন ছাত্র-ছাত্রী একা আসা যাওয়া করবে না। আমরা দলবদ্ধভাবে আসা যাওয়া শুরু করলাম। আমার যে বন্ধু সব সময় ঝগড়া করত সে জানলার ধারে বসতে শুরু করল আমাকে আড়াল করে। যেন জানলা দিয়ে আমায় কেউ তুলে নেবে।আমার বডিগার্ড হল যাওয়া আসার।হাজার হোক পুরুষ তো। কেউ এলেই নাকি মেরে দেবে দুমদুম করে।

      আর যে বন্ধু আমার প্রিয়তম, সে স্কুল শুরুর সময় থেকে আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকতে লাগল ছুটির ঘণ্টা বাজা অবধি। যাতে কেউ হাতধরে তুলে না নিতে পারে।তার সাথে সব সময় চোখ ছলছল, ” কেন গেলি? যদি হাত পা ভেঙ্গে দিত? যদি অন্ধ করে দিত? তখন?” এবং চোখের জল গড়িয়ে পড়ত।পরে শুনেছিলাম আমার এই বান্ধবীও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ভয়ে। বন্ধুরা সবসময় আঁকড়ে ধরে থাকত। সবাই ভীত।

      পুরো স্কুল জুড়ে থমথমে এক পরিবেশ। প্রেয়ারের সময় বড়দিদিমনি সবাইকে জানালেন ঘটনা। এরপর সবাই জনে জনে জিজ্ঞাসা করতে লাগল — কি হয়েছিল কি হয়েছিল ?আমার অবস্থা হল সবথেকে করুণ।কথা বলতে পারতাম না, ইচ্ছাই করত না, বলতে গেলেই কাঁদতাম। মনে করতেও চাইতাম না। কিন্তু সবাইকে উত্তর দিতে হত। ভুলতে চাইতাম কিন্তু ভোলার উপায় ছিলনা।

      সেই সময় নাতো কাউন্সেলিং ছিল, নাই কেউ মনের অবস্থা জানার চেষ্টা করত। ফিরে আসার পর মা বলেছিলেন – ” তুই যে চলে গেলি ভাইকে ফেলে যদি ওকে কেউ কোলে তুলে নিয়ে চলে যেত তখন? একবারও ভাবলি না?” আমার নিজের কি হত সেই চিন্তা মনে স্থান পেল না। সারা দিনরাত ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম যে যদি ভাইকে কেউ নিয়ে যেত তাহলে কি হত ?!!?? রাতে ঘুমাতাম না। কাঁদতাম। কেউ জানত না। শরীর খারাপ হতে লাগল। খেতে কষ্ট হত। সবসময় ত্রাস— যদি ভাইকে নিয়ে যেত।স্কুলের দিদিমনিরা সবসময় বোঝাতেন এরকম যেন আর না করি।বেশ অনেকদিন লেগেছিল নিজেকে সামলাতে। এই ঘটনার ফল হল বাইরের অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলার আত্মবিশ্বাস বা বিশ্বাস নষ্ট হল। সাজগোজ করাকে ভয় পেতে লাগলাম।অচেনা জায়গায় একা বাইরে বের হতে এখনও মাঝে মাঝে ভয় লাগে। বাড়ির লোক ছাড়া কোথাও যেতে পারতাম না। একটা অচেনা অজানা ভয় সবসময় পিছু তাড়া করত।আজ বহুবছর পর মনে পড়লে ভাবি আমার নিজের ক্ষতির পরিমান কত মারাত্মক হত। সেই সময় শিশুদের “good touch, bad touch” বিষয়ে কোনই ধারণা দেওয়া হতনা, অপরিচিত মানুষের সাথে কি ব্যবহার করা উচিত কতটা বিশ্বাস করা উচিত তাও জানানো হতনা, এমনকি বাবার বন্ধু বললেই যে তা সত্যি নাও হতে পারে তাও জানতাম না, নিজেকে রক্ষার কোনও কৌশল শেখানো হত না। শুধু চারটে উপদেশ দিয়ে দেওয়া হত। সেই উপদেশগুলোর কোথায় কি ব্যবহার তাও বলা হতনা। আমাদের স্কুলের মায়া দিদিমনি শুধু একদিন আমাকে সবার থেকে আলাদা করে সব ঘটনা শুরু থেকে শেষ অবধি শুনে বুঝেছিলেন কেন আমি চলে গেছিলাম। একমাত্র মানুষ যিনি ভয় দেখাননি, ভয় দূর করেছিলেন। আমাকে না , দোষটা নিজেকে এবং আমার মাকে দিয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন — “উপকার নিশ্চয়ই করবে পারমিতা, কিন্তু সবার নয়, নিজের ক্ষতি করে নয়। আর উপকার করার আগে বাড়ির লোককে জানিয়ে করবে।আমাদের উচিত ছিল তোমাদের এই বিষয়ে বুঝিয়ে দেওয়া।” ওই বয়সে এর থেকে বেশি বোঝার ক্ষমতা ছিলনা বা বোঝানোও সম্ভব ছিল না। বাড়িতে এসে বাবা-মাকে ভুলটা কোথায় সেটা বুঝিয়েছিলেন। যাতে সবসময় আমাকে ওইসব কথা না বলা হয়। আজ সেই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পেছনে আমার মায়া দিদিমনির অবদান অনেক। নাহলে হয়ত মানসিক রুগীই হয়ে যেতাম।দিদিমনি আজ নেই। কিন্তু ওনার বলা সেই কথাগুলো আজও আমার চলার পথের পাথেয়। ভয়কে জয় করতেও উনিই শিখিয়েছিলেন। তাই হয়ত পরবরতীকালে অনেক ক্ষেত্রে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিতে পেরেছি। সেই ঘটনা আমাকে এক ধাক্কায় অনেকটা বড় করে দিয়েছিল।আজ এত বছর পর লিখতে বসে দেখছি একটুও কিছু ভুলিনি। এমনকি ” গোলাপি জামা”র মুখটা পর্যন্ত মনে আছে – পরিষ্কার। ঘটনার তীব্রতার আন্দাজ এর থেকেই হয়ত করা যায়।

      Professor Answered on March 19, 2024.
      Add Comment
    • RELATED QUESTIONS

    • POPULAR QUESTIONS

    • LATEST QUESTIONS

    • Your Answer

      By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.