আমি আপনার কাছ থেকে কী শিখতে পারি?

    আমি আপনার কাছ থেকে কী শিখতে পারি?

    Train Asked on May 12, 2024 in অনুসরণ.
    Add Comment
    1 Answer(s)

      তুই, তুমি, আপনিঃ

      মনিরুজ্জামান সোহেল

      আপাতভাবে নিরীহ মনে হলেও ‘তুই’, ‘তুমি’ ও ‘আপনি’ শব্দ তিনটি আমাকে খুব ভাবায়। অনেক দেখার পর আমার মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে এই তিনটি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে আমরা ব্যাপক অবিচার করে থাকি। আমরা গরীবকে অবমূল্যায়ন করি; পরিশ্রমীকে অপমান করি; অযোগ্যকে সম্মান করি; নিরীহকে ভয় দেখাই; সাধারণ লোকের আত্মসম্মানে আঘাত করি; সর্বোপরি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করি। চোখ-কান একটু খোলা রাখলেই আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। ছোট ছোট কিছু গল্প বলি।

      জাভেদ মিয়া শিক্ষিত এবং বড় চাকরি করেন। নিজস্ব গাড়ি নাই; বাজার করে রিক্সায় করে আসছিলেন। রিক্সা চালক জাভেদ মিয়ার চেয়ে বয়সে বড়, অশিক্ষিত, দরিদ্র ও দুর্বল। জাভেদ মিয়া রিক্সা চালককে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন না করে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করাতে রিক্সা চালক খুব অবাক হয়ে গেলেন। আমাদের সমাজে তার মতো লোকেরা এ রকম সম্মান খুব কমই পেয়ে থাকেন।

      জলিল মাছ বিক্রেতা; বয়স ৩৫-৩৬। জুম্মার নামাজের পর মসজিদের সামনে মাছ বিক্রি করছিলেন। ৩০-৩২ বছর বয়সের এক ভদ্রলোক তাকে বললেন, ‘কিরে তোর মাছের দাম কতো’। জলিল খুব স্বাভাবিকভাবে মাছের দাম বললেন। ভদ্রলোক জলিলকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতে থাকলেন আর জলিল ‘আপনি’ বলে কথা চালিয়ে গেলেন। জলিলদের সাথে অধিকাংশ ভদ্রলোক এভাবেই কথা বলে থাকে।

      রাফাত ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র। সামনের বছর HSC পরীক্ষা দেবে। লোকাল বাসে করে মিরপুর যাচ্ছিল। বাস চালককে সে চেনে না। বাবার বয়সী বাস চালককে সে ‘মামা’ ডাকছে আর ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছে। “মামা গরুর গাড়ি চালাও নাকি।” বাসের একদম পিছনের সিটে বসা করিম সাহেব বুঝতে পারছেন রাফাত বাস চালককে তাচ্ছিলের সুরে ‘মামা’ ডাকছে এবং ‘তুমি’ বলে তাকে অপমান করছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এটাই এখানকার নিয়ম!

      ধনী ও প্রভাবশালী ইয়াকুব সাহেবের ছোট মেয়ে এবার SSC পরীক্ষা দেবে। মেয়ের জন্য আলাদা গাড়ি ও চালক আছে। চালকের বয়স ইয়াকুব সাহেবের বয়সের কাছাকাছি। চালক তার মালিকের ১৫ বছর বয়সী মেয়েকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন। তার অবশ্য খারাপ লাগে না। কারণ বাসার কাজের বুয়ারাও ঐ ১৫ বছর বয়সী মেয়েকে ‘আপনি’ বলে। ওটাই ঐ বাসার নিয়ম।

      আপনি কাছের কাউকে হয়তো ‘তুমি’ করে বলেন। যেকোনো কারণে তার উপর রেগে গেলেন এবং ‘তুই’ করে বলা শুরু করলেন। কখনও কখনও নিজেদেরকে বস বানানোর জন্য অন্যদেরকে আমরা ‘তুমি’ বা ‘তুই’ বলা শুরু করি।

      উপরের ঘটনাগুলো আমাদের চেনা; আমাদের কাছের; আমরা এগুলোতে অভ্যস্ত। ভালোইতো চলছে! এগুলো নিয়ে আবার কথা বলার কী আছে?

      একটি ভালো সমাজের জন্য তার সদস্যদের মধ্যে পারস্পারিক সম্মানবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার ভালো অবস্থানের কারণে কাউকে আমি ‘তুমি’ বা ‘তুই’ করে বললে বা তার আত্মসম্মানে আঘাত করলে সমাজ ছোট হয় বা দেশের মধ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পায় না।

      শুধুমাত্র এই ‘তুই’, ‘তুমি’ ও ‘আপনি’-এর কারণে প্রতিদিন কতো লোকের আত্মসম্মানে আঘাত লাগছে তার কোনো হিসাব নাই। দুর্বলকে সম্মান করতে না পারলে কিসের সভ্য আমরা!

      আমরা কারো কাছ থেকে কোনো সেবা কিনলেই তার আত্মসম্মানে আঘাত দেওয়ার অধিকার পাই না। কোনো বাস শ্রমিক, কোনো রিক্সা চালক, কোনো সবজিওয়ালা, কোনো ছোট দোকানদার, বাসা ব্যবস্থাপনার সহকারীরা আমাদের প্রয়োজনে আমাদেরকে সেবা দিয়ে থাকে। আমাদের জীবনের জন্য তারা মূল্যবান।

      আপনি হয়তো ভাবতে পারেন ‘আমিতো সারা জীবনই এদেরকে তুমি / তুই করেই বললাম; এদেরকেতো খুশিই দেখি’! বিষয়টি আসলে এমন নয়। তাদের আসলে করার কিছু নেই। তাদের এই অবস্থায় আপনি একবার পড়লে সারা জীবন ভুলতে পারবেন না। তারা তো প্রতিনিয়ত পড়ছে; তাই মনে রাখে না!

      আপনি হয়তো আমাকে বলবেন ‘এভাবে কথা না বললে তারা কাজ করবে না বা আপনাকে মান্য করবে না’। পরিস্থিতি আসলে আমরাই এমন করেছি। সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা খুব খারাপ। কখনও কি ভেবে দেখেছেন কেন খারাপ? সমাজের কতো জন লোক তাদের সাথে ভালো আচরণ করে?

      আমার মনে আছে ছোট বেলায় আমি এক হিজরার পাশে বসে বাস ভ্রমণ করেছিলাম এবং তার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছিলাম বলে সে খুব অবাক হয়েছিল; কেউ তাদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে না। পরে আমি অবাক হয়েছিলাম। কারণ, আমার এই ঘটনা নিয়ে আমার আশেপাশের মানুষ হাসাহাসি শুরু করেছিল। ইংল্যান্ডের হিজরারা খারাপ না; বাংলাদেশের হিজরারা খারাপ। বাংলাদেশের হিজরারা একটা অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে থাকে।

      একটা সমাজে যখন কোনো নিয়ম বা প্রথা অনেক দিন ধরে চলতে থাকে তা আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক মনে হয় এবং তা থেকে আমরা বের হতে চাই না। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির জন্য রাজা রামমোহন রায়কে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছিল। দাস প্রথা বিলুপ্তিও স্বাভাবিকভাবে হয়নি। কিসের মধ্যে কী…! আমি আসলে এটা বুঝতে চাচ্ছি সমাজের অধিকাংশ লোক যা মেনে চলে বা মনে করে তা নিয়ম হলেও তা সবসময় ন্যায় নয়।

      এই লেখার মাধ্যমে আমি আসলে কী চাই? আমি চাই সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ‘তুই’, ‘তুমি’ ও ‘আপনি’-এর মধ্যে যেকোনো একটা থাক। প্রথম দিকে মনে হবে কী অনিয়মের মধ্যে পড়লাম! কিন্তু আস্তে আস্তে এটাই নিয়ম হয়ে যাবে। দুর্বল আত্মসম্মানের সাথে বাঁচবে।

      ইংল্যান্ডের বাসগুলো থেকে যাত্রী নামার সময় কী হয় জানেন? প্রত্যেক যাত্রী বাস চালককে ধন্যবাদ জানায়। বাস চালককে যখন বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দেওয়া হচ্ছে তখন বাস চালকও যাত্রীকে সম্মানের চোখে দেখছে। ‘মামা বাস থামাও; নামবো’ বললেও বাস থামে, কিন্তু মামার মধ্যে যে আবেগের জন্ম দেয় তা ঐ বাস যাত্রীকে সম্মান করতে শেখায় না।

      পারস্পারিক সম্মান বোধ ছাড়া একটি সমাজ সবসময় অস্থির থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দয়া করে আমাদের সমাজের দিকে একটু তাকিয়ে দেখেন। কোনো বাস বা ট্রাক দুর্ঘটনায় চালককে বেদম প্রহার করা হয়। গরীব চালকদেরকে ‘তুমি’ বলা হয় ও ‘মামা’ ডাকা হয়। চালকরা তাহলে যাত্রীদের প্রতি সম্মান বা ভালোবাসা শিখবে কার কাছ থেকে?

      কারও সাথে ভালো আচরণ করলে বা সম্মান দেখালে আপনারই লাভ। বস যদি অফিসের কর্মচারীদেরকে সম্মান দেখান, বিনিময়ে কর্মচারীরা আন্তরিকভাবে কাজ করবে। দুর্বলকে যদি সম্মান করেন সে আপনাকে সম্মান করবে এবং ভালোবাসবে। সাধারণত নিজেদেরকে বড় দেখাতেই আমরা দুর্বলদের সাথে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ ব্যবহার করি। দুর্বলদেরকে আমরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চাই, তুমি আর আমি এক না। আমি বড়! তোমার চেয়ে আলাদা!

      ‘তুই’, ‘তুমি’ ও ‘আপনি’-এর মধ্যে, আমার কাছে, ‘তুমি’ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেকোনো একটা যদি আমরা ব্যবহার করতে চাই, তাহলে ‘আপনি’তে যাওয়া সহজ হবে। ভেবে দেখুন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও সবচেয়ে দুর্বল একে অপরকে একই শব্দে সম্বোধন করছে। এটাই গণতন্ত্র; এটাই সভ্যতা; এটাই সৌন্দর্য।

      ইংল্যান্ডের ব্রাইটনের এক রেল ষ্টেশনে একজন ক্লিনার কাজ করছিলেন। পাশেই কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ধূমপান করছিল। তার পাশেই একটা সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘ধূমপানমুক্ত এলাকা’। আমাকে অবাক করে দিয়ে ঐ ক্লিনার ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে সাইনবোর্ড দেখিয়ে ধূমপান করতে নিষেধ করলো। তারাও দুঃখিত বলে আর ধূমপান করলো না।

      ঘটনাটিকে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করে দেখুন। একজন ক্লিনার ও একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মধ্যে ‘তুমি’ এবং ‘আপনি’ অদৃশ্য কিন্তু বিশাল এক দূরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের বয়স কম হলেও একজন ক্লিনার তাকে ‘আপনি’ বলতে বাধ্য! আর ক্লিনাররা সাধারণত ‘তুমি’ বা ‘তুই’ হয়ে থাকে। ‘আপনি’ সম্বোধনের সুবিধাভোগীকে ‘তুমি’ সম্বোধনের কেউ বলতে পারে না তার কী করা উচিত বা সে আইন মানছে না। এটা আসলে বর্ণবাদের চেয়েও মারাত্মক! এটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক, কারণ সতীদাহ প্রথাও এক সময় স্বাভাবিক ছিল।

      মনের ভিতর কষ্ট রেখে বাধ্য হয়ে কাউকে ‘আপনি’ বললে যেমন তাকে সম্মান করা হয় না; একইভাবে মনের মধ্যে দম্ভ রেখে কাউকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বললেই নিজে বড় হওয়া যায় না। সমাজে শুধু অস্থিরতা বাড়ে।

      আমি জানি না সমাজের দুর্বল সদস্যদেরকে আপনি ‘তুই’, ‘তুমি’ নাকি ‘আপনি’ বলেন! যদি ‘তুই’, বা ‘তুমি’ বলে থাকেন আজকেই তাদেরকে একবার ‘আপনি’ বলে দেখুন, দেখবেন কী মানসিক তৃপ্তি আপনি পান! আপনি ‘সবল’ কিন্তু ‘দুর্বল’কে সম্মান করেন – এটা আপনাকে আরও বড় করে তুলবে। সমাজের সব ‘সবল’দেরকে দুর্বলরা পছন্দ করে না। দুর্বলদের পছন্দ-অপছন্দও গুরুত্বপূর্ণ! প্রকৃতি বড় রহস্যময় এবং প্রকৃতির কাছে কেউই সবল নয়!

      মানুষকে খুশি করা খুব কঠিন কাজ। কিন্তু দুর্বল মানুষকে খুশি করা কঠিন নয়। একটু ভালো আচরণ করুন; সম্মান দেখান; দেখবেন রহস্যময় প্রকৃতি আপনাকে খুশি করছে!

      Professor Answered on May 12, 2024.
      Add Comment
    • RELATED QUESTIONS

    • POPULAR QUESTIONS

    • LATEST QUESTIONS

    • Your Answer

      By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.