আমি আসলে কে? আমার দেহ নাকি মন?
আমি আসলে কে? আমার দেহ নাকি মন?
“আমি” বলতে যদি সনাতন দর্শনে যাকে “আত্মা” বলে তাই বুঝি তাহলে প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে “আমি আমার দেহ” এটা সত্যি হতে পারেনা কারণ “আমি” তাই যা নিত্য ও অভিন্ন । কিন্তু আমার দেহ নিত্য নয়, তা পরিবর্তনশীল । সময়ের সাথে-সাথে দৈহিক আকৃতি ও গঠনের পরিবর্তন তো বটেই, প্রতিমুহূর্তে আমাদের শরীর থেকে মৃত কোষেরা ঝরে জায়গা করে দিচ্ছে নতুন কোষদের । দেহকে “আমি” বলে মানলে তাই সেই “আমি”কে নিত্য ও অভিন্ন বলা সম্ভব নয় । অতএব “আমি” যে সে আবশ্যিকভাবে দেহাতিরিক্ত ।
তবে কি “আমি” মন? এটা আপাতভাবে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়— “আমি” বলে সত্তাটি ইচ্ছা, সংকল্প, সুখ, দুঃখ, ক্রোধ ইত্যাদি অনুভব করে । এগুলি সবই মনের ধর্ম । আবার ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করতে হলেও মনঃসংযোগের প্রয়োজন হয় (যে-কারণে আমরা বলি “মন দিয়ে দেখ”, “মন দিয়ে শোনো” ইত্যাদি) যেহেতু ঘুমন্ত বা অচেতন অবস্থায় ইন্দ্রিয় থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোনো ইন্দ্রিয়ানুভূতি হয় না । এর অর্থ মনই আসল দ্রষ্টা, শ্রোতা, চিন্তক ও জ্ঞাতা ।
কিন্তু মন কি নিত্য বা অভিন্ন? এমনটা দাবী করাতেও সমস্যা আছে কারণ আমাদের মনও পরিবর্তনশীল । শিশুবয়সের, যৌবনের ও বৃদ্ধবয়সের মন কারও একইরকম থাকে না । তাছাড়া আমাদের মনের সাথে মস্তিষ্কের যে একটা সংযোগ আছে তা অনস্বীকার্য । মনের যে-কোনো অনুভূতির জন্য মস্তিষ্কে অনুরূপ ক্রিয়া সনাক্ত করা যায় । আমাদের দেহে মস্তিষ্কের অবস্থানে যেখানে মনের অবস্থানও সেখানেই অনুভূত হয়, দেহের অন্য কোথাও তা অনুভূত হয় না । এই যুক্তি মানলে বলতে হয় মন “আমি” বা “আত্মা” হলে তা দেহনির্ভর । কিন্তু একটু আগেই বলেছি যে আত্মা দেহাতিরিক্ত । সেক্ষেত্রে তা একই সাথে দেহনির্ভর কী করে হতে পারে?
অতএব দেখা যাচ্ছে যে মনকেও “আমি” বলাতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে । তবে “আমি” আসলে কে?
ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা এই প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর দিয়েছে, তবে সেই আলোচনায় না গিয়ে আপাতত আমি একটা অন্য উত্তর দেব— “আমি আমার দেহ না মন?” এই প্রশ্নটা হয়তো “একটা মোমবাতি আসলে কী? তার মোমের শরীর নাকি তার শিখা?” জিজ্ঞাসা করার মতো ।
মোমবাতিটিকে না জ্বালানো হলেও আমরা তাকে যেমন “মোমবাতি” বলি তেমনি ঘুমন্ত অবস্থাতেও আমাদের “আমিত্ব”বোধ থাকে (যে কারণে আমরা বলতে পারি “আমি গতরাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম”) । জাগ্রত অবস্থায় আমরা হলাম জ্বলন্ত মোমবাতির মতো— আমাদের দেহ হল মোমবাতির শরীর, আর আগুনের শিখা হল মন । শিখা মোমবাতি ছাড়া জ্বলতে পারে না, তেমনই মনের দেহ ব্যতীত অস্তিত্ব নেই । আবার শিখা না থাকলে মোমবাতি প্রকৃত অর্থে “বাতি”র ভূমিকা পালন করে না যেহেতু শিখাহীন মোমবাতি অন্ধকার দূর করতে অক্ষম । তেমনই অচেতন দেহ মনের ক্রিয়া ব্যতীত “আমিত্ব”র জন্ম দিতে পারে না ।
এই উপমা মানলে “আমি” যেমন একদিকে মননির্ভর তেমনই অন্যদিকে তা দেহনির্ভর (কিংবা মস্তিষ্কনির্ভর), কিন্তু একা দেহ বা মন কোনোটাই নয় ।