কৃষ্ণ কে ছিলেন?

    হিন্দু ধর্মের একজন দেবতার নাম কৃষ্ণ। কিন্তু যতটুকু জানি হিন্দু পুরাণে তিনি একজন বিশেষ ব্যক্তি। তিনি আসলে কে ছিলেন? 

    Doctor Asked on March 1, 2015 in সাধারণ.
    Add Comment
    1 Answer(s)

      কৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। তাঁকে স্বয়ং ভগবান এবং বিষ্ণুর পূর্ণাবতারও মনে করা হয়। গীতায় বলা হয়েছে যে, অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশ এবং ধর্ম ও সজ্জনের রক্ষার জন্য তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে আগমন করেন। তাঁর এই আগমন ঘটে কখনও মনুষ্যরূপে, কখনও বা মনুষ্যেত্বর প্রাণিরূপে এবং একেই বলা হয় অবতার।

      কৃষ্ণ
      কৃষ্ণের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। ঋগ্বেদে একাধিকবার (১। ১০১, ১১৬-৭, ১৩০ ইত্যাদি) কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। সেখানে তিনি ইন্দ্রবিরোধী একজন অনার্য যোদ্ধা হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। কোথাও তাঁকে ঋষি এবং অসুরও বলা হয়েছে। ছান্দোগ্যোপনিষৎ (৩।১৭।৬-৭) এবং কৌষিতকীব্রাহ্মণে (৩০।৬) কৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়েছে। তাঁর গুরু ছিলেন ঘোর-আঙ্গিরস। কেউ কেউ বলেন, এই কৃষ্ণই পৌরাণিক যুগে বাসুদেব কৃষ্ণে পরিণত হয়েছেন। মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণবকাব্যে যে কৃষ্ণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাঁর আবির্ভাব দ্বাপর যুগে। প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে মাতুল কংসের কারাগারে ভাদ্রমাসের অষ্টমী তিথিতে কৃষ্ণের জন্ম। তাঁর জন্মসূত্রে এ দিনটি প্রতিবছর জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়।

      কৃষ্ণকে কেউ কেউ অনার্য দেবতা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের মতে আদিম জনগোষ্ঠীর উপাস্য এই দেবতা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তন হয়। কৃষ্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তি কিনা এ বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন তাঁর মানবীয় কোনো অস্তিত্ব ছিল না, আবার কারও কারও মতে তিনি একজন আদর্শচরিত্র ঐতিহাসিক পুরুষ, ধর্মপ্রবক্তা ও সংস্কারক ছিলেন এবং কালক্রমে ভক্তরা তাঁকে দেবতা, এমনকি ভগবানের পর্যায়ে উন্নীত করেন।

      কৃষ্ণ চরিত্রটি খুবই বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাতে তাঁর তিনটি প্রধান রূপ লক্ষ্য করা যায়: পরোপকারী, প্রেমিক এবং রাজনীতিক। পরোপকারীর ভূমিকায় কৃষ্ণকে দেখা যায় তাঁর শিশু বয়স থেকেই। কংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য জন্মের পরই পিতা বসুদেব তাঁকে গোকুলে নন্দ-যশোদার ঘরে রেখে আসেন। কিন্তু কংস এ কথা জানতে পেরে গোকুলের সব শিশুকে হত্যার নির্দেশ দেয়। কংসের নির্দেশে পূতনা রাক্ষসী বিষাক্ত স্তন্য পান করিয়ে একের পর এক শিশুদের হত্যা করতে থাকে। একদিন শিশু কৃষ্ণকে হত্যা করতে গেলে তাঁর হাতে সে নিজেই নিহত হয়। এভাবে শিশু কৃষ্ণ গোকুলের শিশুদের রক্ষা করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি বৎসাসুর, অঘাসুর, বকাসুর প্রভৃতি অপশক্তিকে বিনাশ করেন। এছাড়া তিনি কালীয়দহে কালীয় নাগ দমন, বৃন্দাবনকে রক্ষার জন্য দাবাগ্নি পান, ইন্দ্রের কোপ হতে গোপগণকে রক্ষার জন্য গোবর্ধনগিরি ধারণ ইত্যাদির মাধ্যমে বাল্যকালেই নানাভাবে জনসাধারণের উপকার করেন।

      কৈশোরে কৃষ্ণ যে কাজগুলি করেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কংসবধ। অত্যাচারী কংস ছিল মথুরার রাজা। সে নিজের পিতা উগ্রসেনকে কারাগারে আটক রেখে সিংহাসন অধিকার করে। এমনকি ভবিষ্যদ্বাণীতে জ্ঞাত তার মৃত্যুর কারণ কৃষ্ণের আবির্ভাব ঠেকাতে সে নিজের বোন-ভগ্নীপতি অর্থাৎ কৃষ্ণের মাতা-পিতা দেবকী-বসুদেবকেও কারাগারে আটক রাখে এবং নিজের হাতে বোনের সন্তানদের হত্যা করে। তাই কৃষ্ণ মথুরায় এসে এই পাপাচারীকে হত্যা করে মাতামহ এবং পিতা-মাতাকে কারাগার থেকে উদ্ধার করেন এবং মথুরায় শান্তি স্থাপন করেন। এমনিভাবে অপশক্তির হাত থেকে শুভশক্তিকে রক্ষার জন্য কৃষ্ণ পরবর্তীকালে আরও অনেক দুর্বৃত্তকে হত্যা করেন বা করান।

      কৃষ্ণের প্রেমিক রূপের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বৃন্দাবন লীলায়। হরিবংশপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থে তিনি চিত্রিত হয়েছেন একজন প্রেমিক, ভক্তসখা এবং গোপীজনবল্লভরূপে। এখানে তিনি সমাজের একেবারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবন কাটিয়েছেন। এ সময় তাঁর জীবনে স্বাভাবিক ঘটনার পাশাপাশি অনেক অস্বাভাবিক ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। গোপকন্যা এবং গোপস্ত্রী রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয়-সম্পর্ক পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল প্রেরণা। গোপনারীদের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক তার মধ্যে নিহিত রয়েছে ভারতীয় বেদান্তদর্শনের জীবাত্মা-পরমাত্মা সম্পর্কিত মূলতত্ত্ব। সে তত্ত্ব হলো জীবাত্মা-পরমাত্মা এক; পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই জীবের প্রধান কাঙ্ক্ষিত বিষয়, যাকে বলা হয় মোক্ষ। কৃষ্ণ সেই পরমাত্মা, আর সব জীবাত্মা। কৃষ্ণের সখাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন শ্রীদাম, সুদামা, উদ্ধব প্রমুখ। অর্জুন তাঁর সখা এবং আত্মীয়ও। এঁদের সঙ্গে কৃষ্ণের আচরণ একজন সাধারণ মানুষের মতোই।

      কৃষ্ণের বুদ্ধিদীপ্ত এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো তাঁর রাজনীতিক রূপ, যার পরিচয় পাওয়া যায় মহাভারতে। এখানে তিনি একজন রাজা (দ্বারকার রাজা), রাজনীতিক, কূটনীতিক, যোদ্ধা এবং দার্শনিকরূপে চিত্রিত হয়েছেন। এ পর্বে তাঁর কর্মকান্ডের প্রায় সবই মানবোচিত। পান্ডবদের পক্ষে দৌত্য-ক্রিয়া ও তাঁদের প্রাপ্য রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডবদের পরামর্শ দান ও বিজয়ী করা, দুর্যোধনাদি দুর্জনদের বিনাশ ও যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করা, অর্থাৎ অধর্মের বিনাশ করে ধর্মকে প্রতিস্থাপন করা ইত্যাদি কাজ কৃষ্ণ এ পর্বেই সমাপ্ত করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তিনি নিজে অস্ত্র চালনা করেননি বটে, কিন্তু যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন মূলত তিনিই। দুর্বৃত্ত জরাসন্ধ বধ ও শিশুপাল বধও এ পর্বেরই ঘটনা। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে কৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষাত্রধর্ম এবং আত্মা সম্পর্কে যে উপদেশ দিয়েছেন তা ভগবদ্গীতা বা সংক্ষেপে গীতা নামে খ্যাত। এভাবে কৃষ্ণ অধর্মের বিনাশ ও দুষ্টের দমন করে ধর্ম স্থাপন ও শিষ্টের পালন করেছেন। এর কিছুকাল পরে তাঁর নিজের যদুবংশে অনাচার দেখা দিলে তাও তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। কৌশলে তিনি যদুবংশ ধ্বংস করে নিজে এক ব্যাধের শরাঘাতে ইহলোক ত্যাগ করেন।

      কৃষ্ণের এই কাহিনীর পিছনে ঐতিহাসিক সত্য থাক বা না থাক, তিনি যিনিই হোন না কেন, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন গ্রন্থে এবং ভক্তদের বোধ ও বিশ্বাসে, মন ও মননে তাঁর যে আদর্শ রূপটি গড়ে উঠেছে, তার প্রভাব হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিতে এবং সংস্কৃত ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। ভারতীয় অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যও কৃষ্ণকাহিনীর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দম্, বড়ুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের এক বিরাট অংশ কৃষ্ণকাহিনী নিয়ে রচিত। পদাবলি কীর্তন, পালাগান, বিচ্ছেদী গান ইত্যাদি লোকসঙ্গীত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়-কাহিনীকে আশ্রয় করেই রচিত হয়েছে। এগুলি এক সময় বাঙালি সমাজে খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং আজও তা শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়।

      Professor Answered on March 1, 2015.
      Add Comment
    • RELATED QUESTIONS

    • POPULAR QUESTIONS

    • LATEST QUESTIONS

    • Your Answer

      By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.