জীবনে পড়াশুনো করা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
জীবনে পড়াশুনো করা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
- দুটো সত্য ঘটনা বলি। তাহলে বোঝা যাবে কেন গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম ঘটনা :
এই ঘটনাটি আমার নিজের জেঠুর মেয়েকে নিয়ে। ওরা তিন ভাই বোন। দিদি বড়, বাকি দুজন ছোট। জেঠু আধাসামরিকবাহিনীতে চাকরি করত। জেঠুমা বিয়ের প্রথম কয়েক বছর বাইরে কাটিয়েছে। তারপর গ্রামে চলে আসে।
আমার দিদির পড়াশোনার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। জেঠুমা বেশি পড়াশোনা করে নি। দিদি বহু কষ্টে নিজের স্নাতকের পড়া শেষ করেছে। ভালো গাইড পাই নি। হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে স্কুলে পড়তে যেত। কলেজে উঠে সাইকেল পায়। অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
ঊচ্চমাধ্যমিকের পর থেকে সম্বন্ধ আসত। অনেকে বলত, ‘ বড় মেয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। না হলে মহা সমস্যা। মেয়ে হয়ে এত পড়ে কী করবে শুনি? ‘ জেঠুও বাড়িতে এলেই সম্বন্ধ দেখতে ছুটত। আমাদের জাতের শিক্ষার হার খুব বেশি নেই। তখন তো আরও কম ছিল। এখন তাও করছে অনেকে। দাদাগুলোও পড়া শেষ করে নি। যাইহোক, ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে, রেজাল্টও বের হয় নি, দিদির এক প্রাইমারি শিক্ষকের সাথে বিয়ে হয়। সে দিদির থেকে প্রায় ১৫ বছরের বড়। জামাইবাবু খুব বুদ্ধিমান ছিল। ওদের বাড়ির সবাই পড়াশোনায় ভালো। জামাইবাবু কলকাতা কলেজের স্নাতক, সাম্মানিক। তবে পড়াশোনার প্রচুর অহংকার ছিল।
দিদি বিয়ের পর থেকেই দেখত ঔষধ খাচ্ছে। ‘কী খাচ্ছ?’ – জিজ্ঞাসা করলে বলত, ‘ও কিছু না।’ বেশি বললে বলত, ‘তুমি সাধারণ মেয়ে, বুঝবে না।’ বাকি অন্যসব ভালো। শুধুমাত্র এই ব্যাপারে ঐরকম করত।
এইভাবে কয়েকবছর কাটল। একদিন জামাইবাবুর খুব শরীর খারাপ হয়ে যায়। টেস্ট করা জানা যায়, জামাইবাবুর যক্ষা, সাথে মাথায় টিউমার হয়েছে। আমাদের জামাইবাবু বিয়ের ছয় বছরের মাথায় ফুটফুটে একটি মেয়েকে অনাথ করে দিয়ে চলে গেল। দিদি হল বিধবা। জামাইবাবু নিজেই বলেছিল, ‘ আমি দেবীকে বিসর্জন দিলাম। পারলে আমায় ক্ষমা কর। ‘ দিদি শেষ দিন পযর্ন্ত প্রাণপাত করে সেবা করে গেছে। ঐ ২৫- ২৬ বছরের দিদি, তার ছোট্ট ৪ – ৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে বাপের ঘরে এসে উঠল।
সেই তখন থেকে এখনও পযর্ন্ত যুদ্ধ করে চলছে। যেহেতু জামাইবাবু সরকারি বিদ্যালয়ের প্রাইমারি শিক্ষক ছিল, আর দিদিও স্নাতক, তাই জামাইবাবুর চাকরিটা দিদি পেয়েছে। দিদি যদি কম পড়াশোনা করত, তবে শিক্ষিকা হতে পারত না। কত সমস্যা হত।
উপলব্ধি :
দিদির জীবনের ঘটনা দেখলে আমার মনে হয়, কখন কী দুর্ঘটনা ঘটবে কেউ জানি না। তবে আর যাইহোক অন্তত স্নাতক পযর্ন্ত পড়া উচিত।
দ্বিতীয় ঘটনা :
এটা আমাদের পাড়ার ‘চ্যাটার্জী পরিবারের’ ঘটনা। মেয়েটির পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো নয়। ওরা একটি ভাই, একটি বোন। সেই মেয়েটি আমাদের পাড়ায় বউ হয়ে আসে। ছেলেরা দু ভাই। ছেলের বাবা চাকরি করত। এখন অবসর নিয়েছে। পেনশন পান।
মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে, টুকটুকে ফর্সা। ঊচ্চমাধ্যমিক দিয়ে তার বিয়ে হয়েছিল, বয়স ১৮+। মেয়েটি যত ফর্সা, ছেলেটি তত কালো। ছেলেটি খুব মদ ( খাওয়াটা সমস্যা নয়, নিজেকে সামলাতে না পারাটা সমস্যা, যে নিজেকে সামলাতে পারে না, তার খাওয়াটাও অন্যায়। কারণ, সবার সবকিছু সহ্য হয় না। ) খায়। ছেলেটি তেমন কাজও করে না। কোন কম্পানির কী করে জানি না। এখন তো কাজটাও চলে গেছে, তার উপর লিভার খারাপ হয়ে গেছে। বিয়ের সময় বলেছিল, পড়াবে। তারপর আর পড়া হয় নি। একটি ৪ – ৫ বছরের মেয়ে আছে। শ্বাশুড়ির অভিযোগ, মেয়েটা পাকা নিজেই পড়ে নি। কাজের হিসেব নেই। অত ছোট মেয়ে এত কাজ কী পারে? তাকে তো শিখিয়ে দিতে হবে। কচি বউও চায়, আবার কাজে পাকাও চায়, তা বললে কী করে হবে ?
আমাদের বাড়িটা ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরে। ওদের খুব ঝগড়া হয়। বউকে খুব মারে, ছোট্ট মেয়েটার সামনেই মারে ( অন্যায় হলে ভালো করে বোঝাতে পারে, গায়ে হাত তোলা ঘৃণ্য অপরাধ )। একদিন পাড়ার অনেকের কাছে বলছিল, ‘ আত্মহত্যা করব।’ তারপর সবাই ঐটি করতে নিষেধ করল। এইবার যদি বলেন, ঝগড়া কার ঘরে না হয় ? সত্যিই তাই। আমাদের ঘরেও হয়, বেশিরভাগ ঝগড়া ভাইকে নিয়ে হয়। বদ সঙ্গী জুটেছিল, নিজেরা খরচা করে ভাইয়ের নামে চালিয়ে দিত। এখন পরিবর্তন হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। সেটা বড় ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা হল – কাল শুনলাম মেয়েটিকে তার বাচ্চা সহ বাপের বাড়িতে রেখে দিয়ে এসেছে। এইবার বলুন ওর কী হবে? পড়াশোনাও শেষ করেনি। বাপের ঘরের অবস্থাও খারাপ। এখন তো এমনিতেই সবার কাজ চলে যাচ্ছে। যদি অন্য একটি ব্যবস্থা করে রাখত, তবে এইরকম হত না। ওর কী হবে আমি জানি না !
উপলব্ধি :
অন্য একটা ব্যবস্থা সবসময় করে রাখা উচিত। এমনভাবে নিজেকে তৈরি করা উচিত, যাতে নিজের অন্ন জোগাড়ের সক্ষমতা থাকে। অবশ্যই স্নাতক পযর্ন্ত পড়া শেষ করা দরকার। গরিব হলেও কষ্ট করে, টিউশন পড়িয়ে শেষ করা দরকার। সরকার থেকে যে ‘বৃত্তি’ দেয়, তার সঠিক ব্যবহার করা উচিত। ফালতু না খরচ করে নিজের উন্নতির জন্য ব্যবহার করা উচিত। তারপর যদি বিয়ে হয়েও যায়, তাও পড়তে হবে। গাল খেয়েও পড়তে হবে।
ধন্যবাদ। 🙂
ফুটনোটগুলি