জীবন কি বিচিত্র?
আমি হাবিব ইমন!
আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তারা উভয়েই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবঃ প্রাপ্ত কর্মকর্তা।
বাবা ছিলেন আর্মি মেডিক্যাল কোর এ, তাই এখনো তিনি নিজ এলাকায় চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
আর আমি একে তো একমাত্র সন্তান তার উপর আবার জন্ম নিয়েছি বাবা-মায়ের বিয়ের ১৪ বছর পরে। সঙ্গত কারনেই আমার আদর, সোহাগ, বা ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না কোন কালেই।
তো সেই কারনেই ছোটবেলা থেকে ছিলাম খানিকটা ডানপিঠে স্বভাবের। বাবা-মা ধরতে গেলে আমাকে টাকা দিয়েই মানুষ করেছেন। আমার যে কোন আবদার তারা টাকা দিয়েই মিটিয়েছেন জন্যই কখনো টাকা ছাড়া কিছু বুঝিনি।
যেমনঃ শিশুকালে বাজারের সেরা খেলনা, সেরা ভিডিও গেমস, স্কুল লাইফে বাজারের সেরা সাইকেল, সেরা মোবাইল আর কলেজ লাইফে ইয়ামাহার বাইক চাওয়া মাত্রই পেয়ে যাই।
কলেজের গন্ডি পেরিয়ে মেডিক্যালে চান্স হলো না, আর বাবা মায়ের কাছে প্রাইভেট মেডিক্যালের তেমন গুরত্ব না থাকায় ২০১৩ সালে ভর্তি হই রাজশাহী ম্যাটসে। ভালই চলছিলো দিনকাল।
এর মাঝে বাবা অসুস্থ হয়, তাই একটু তড়িঘড়ি করেই তাদের পছন্দ মত আমার মতই ঠিক বাবার একমাত্র মেয়ের সাথেই আমার বিয়ে দেয়।
আমার মতো তারও ছিলো না কোন ভাই-বোন।
একদম অল্প বয়সে, বয়স তখন সবে মাত্র ২১ বছর। কাগজে কলমে তো আরও কম।
বিয়ের পরে সব ভালই চলছিলো, বাবার একটা ছোট ক্লিনিক ছিলো, ম্যাটস শেষ করে সেখানেই যোগদান করি, আর পাশাপাশি টুকটাক ব্যাবসা চালাই। বাবার পুকুর, ফলের বাগান আর জমি জমা দেখভালের দায়িত্ব আমার হাতেই চলে আসে।
বিয়ের এক বছরের মাথায় স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হয়, তার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান।
সবার সে কি আনন্দ, মেয়ে আসার সাথে সাথে আমারও সব কিছুতে আল্লাহ্ বরকত একবারে ঢেলে দেন। তারপর ৬ মাস যখন মেয়ের বয়স তখন তার লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। ঢাকার এ্যাপোলো হসপিটালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে প্রায় সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়।
অর্থনৈতিক ভাবে হালকা আঘাত লাগলেও তা সারিয়ে উঠি খুব তাড়াতাড়ি। মেয়ের বয়স যখন ২ বছর তখন আবারও স্ত্রী সন্তান সম্ভবা, আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জানলাম এবার ছেলে হবে।
ভাবলাম যাক পরিবার টা একদম সয়ংসম্পূর্ণ হলো।
অতঃপর বেশ ভালই চলছিলাম।
সে সময় বিশ্বে লবডংকা বাজিয়ে আসে ভয়াল করোনার থাবা। দেশে তখন করোনা সুরক্ষা সামগ্রীর বিরাট সংকট। চায়নাতে অধ্যায়ন ও কর্মরত কিছু বন্ধুর মাধ্যমে, মাক্স, গ্লোভস, পিপিই র স্যানিটাইজার সহ অনেক কিছুই ইমপোর্ট করা শুরু করি। সে ব্যাবসাও তখন রমরমা। ২/৩ গুন লাভ হচ্ছিলো।
এদিকে আমিও আইসোলেশনে ডিউটি করে যাচ্ছিলাম নিরালস ভাবে।
তবে অন্যের সুরক্ষা দিতে দিতে কখন যে নিজের ঘরে করোনা ঢুকলো, তা বুঝতে পারিনি।
ওই যে বলে না?
“তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে “
আমার হলো সে হাল…
অবশেষে ৬ মাসের গর্ভাবস্থায় টানা ১৭ দিন ICU তে করোনার সাথে লড়াই করে পরাজিত হয় আমার স্ত্রী।
পেটের সন্তান গর্ভেই মারা যায়। সেই সন্তান কে সে নিয়েই চলে যায়, আর রেখে যায় আমার কাছে আড়াই বছরের মেয়ে, যে দিনে অন্তত ১০০ বার আমার কাছে মায়ের খোঁজ করে।
যেহুত আমি একদম একা হয়ে গেছিলাম, তাই মেয়ে কে সামলানোর জন্য স্ত্রী মৃত্যুর ৫ মাস পরে পারিবারিক ভাবে আবারও বিয়ে করি। আর এদিকে আমার জিবনের সতর্ক সংকেত চলে এসেছিলো, ৪ টা বিজনেসে একবারে লস খাই, যেহুত আমি দুই মাসের মতো কোন কিছুতেই মনযোগ দিতে পারিনি।
তাই সঞ্চয় শেষ হয়ে চাহিদার চাকা যেয়ে নামে ধার-দেনায়। কত বন্ধু-বান্ধবই তো ছিলো কিন্তু বিপদে খুব কম মানুষকেই পেলাম। তবে মুখোশধারী কিছু বন্ধু সাহায্যর হাত বাড়ালো, তাদের থেকে তিন লক্ষ টাকা ধার নিলাম, ব্যাস বিপদ শুরু…
তারা বিনা সুদের ঋনের কথা বলে, পরে এসে দাবি করলো ১৫ লক্ষ টাকা, স্বাক্ষর জালিয়াতি আর ভূয়া কাগজ পত্র করতে বেশী বেগ পেতে হয়নি তাদের।
আমার নিজের কিছু নিকট আত্নীয় টাকার বিনিময়ে বিক্রী হয়ে গেলো তাদের কাছে। এক সময় যাদের বাড়িতে চাল-ডাল কিনে দিতাম, তারাই আঙ্গুল উঁচিয়ে ধরলো চোখের সামনে।
আমার বাবা কে বুঝালো, হাবিব নেশায় জর্জরিত, তাই তার এতো টাকা লোন হয়েছে।
বাবাকে বুঝালাম মানলো না, ডোপটেষ্ট করালাম, সব কিছু নেগেটিভ আসলো। তাও সে শান্ত হয় না, অবশেষে ষড়যন্ত্রের বেড়া জ্বাল ছিন্ন করতে পারলাম না, ডোপ টেষ্টের ঠিক একমাস পরে বাবা আমাকে দিলো রিহ্যাবে।
তিন মাসের নতুন স্ত্রীর সামনে কুকুরের মতো টেনে হিঁচড়ে আমাকে রিহ্যাবে নিয়ে গেলো এক মধ্যরাতে।
সেখানে দেখলাম এক ভিন্ন জগৎ, শারীরিক টর্চারের চেয়েও বেশি মানষিক টার্চারের শিকার হলাম। নেশা না করেও মাতাল আর মানষিক ভারসাম্যহীন রোগীর পাশে দিন কাটাতে লাগলাম। একজন মেডিক্যাল এসিষ্ট্যান্ট হবার পরেও চাড়াল-মুচি সমমনা মানুষও পান থেকে চুন খসলেই কথা শুনাতো। সেখানে ভালো হয়ে থাকলেও পরিবারের মানুষের কাছে সত্য-মিথ্যা জোড়া দিয়ে আমার ব্যাপারে নালিশ চলতে থাকলো, যাকে রিহ্যাবের ভাষায় বলে “ফিটিং” এভাবে এক দুই দিন নয়,
রিহ্যাবে কাটালাম ৬ টা মাস।
এদিকে চাচাতো ভায়েরা ভোগ দখল করলো আমার বাবার সম্পদ। প্রথম ৪ মাসে পরিবারের কারও সাথে দেখা করা বা কথাও বলতে পারলাম না। চারমাস পরে স্ত্রীর সাথে ফোনে কথা হলো, তারপর ৫ মাসে দেখা হলো পরিবারের সাথে, আর ছয় মাসে আমাকে বাসায় নিয়ে আসলো। সেখানের নিম্ন মানের খাবার খেয়ে ওজন কমলো এই ৬ মাসে ২৬ কেজি।
এক ভিন্ন মানুষে রুপান্তরিত হলাম।
যে মানুষ সারাদিন আড্ডা, ঘুরাফিরা, আর খাওয়া দাওয়া নিয়ে পড়ে থাকতো, সে হয়ে গেলো ঘরকুনো।
আমি বাসায় এসেছি প্রায় ৩ মাস। তবে এখনো নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি বাইরের পরিবেশের সাথে। রাস্তা ঘাটে মানুষ দেখলেই রিহ্যাব সম্পর্কিত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে, যা আমার জন্য অসহনীয়।
তাই এখন নিজেকে ঘরের মাঝেই বেশী রাখি।
মাঝে মাঝে রিহ্যাবের কষ্টের সময়ের কথা স্বপ্নে দেখে আঁতকে উঠি ঘুমের ঘোরে, রিহ্যাব ভীতি টা কোন ভাবেই কাটাতে পারছি না আমি।
এ থেকে পরিত্রানের কোন উপায় পাচ্ছিলাম না।
তারপর ফেসবুকে মানসিক চিকিৎসা বিষয়ক একটি গ্রুপ নজরে আসে তাদের কে মেইল করলে তারা আমাকে সমাধান দিতে আশ্বস্ত করে। একজন সাইকোলজিস্ট আমাকে কাউন্সেলিং করেন। এর ফলে আমি আবার জীবনের ছন্দ ফিরে পেয়েছি, আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছি।
জীবন বিচিত্র তাতে আর সন্দেহ কি!