তিতুমীর কে ছিলেন?

    তিতুমীর কে ছিলেন?

    Default Asked on April 11, 2019 in ইতিহাস.
    Add Comment
    1 Answer(s)

      তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) বাংলার প্রজাকুলের উপর স্থানীয় জমিদার এবং ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার প্রতিরোধ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনের নেতা। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার। মুসলিম সমাজে শির্ক ও বিদআতের অনুশীলন নির্মূল করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাঁর আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য।

      তিতুমীরের প্রকৃত নাম সাইয়িদ মীর নিসার আলী। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুর (মতান্তরে হায়দারপুর) গ্রামে ১১৮৮ বঙ্গাব্দের (১৭৮২ খ্রি) ১৪ মাঘ তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন সাইয়িদ মীর হাসান আলী এবং মাতা আবিদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীরের পরিবারের লোকেরা নিজেদের হযরত আলীর (রাঃ) বংশধর বলে দাবি করতেন। তাঁর এক পূর্বপুরুষ সাইয়িদ শাহাদাত আলী ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে বাংলায় আসেন। শাহাদাত আলীর পুত্র সাইয়িদ আবদুল্লাহ দিল্লির সুলতান কর্তৃক জাফরপুরের প্রধান কাজী নিযুক্ত হন এবং তাঁকে ‘মীর ইনসাফ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। শাহাদাত আলীর বংশধরগণ ‘মীর’ ও ‘সাইয়িদ’ উভয় পদবীই ব্যবহার করতেন।

      গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিতুমীর স্থানীয় এক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তিনি ছিলেন কুরআনে হাফেজ, বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ এবং আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী। তিনি ইসলামি ধর্মশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, দর্শন, তাসাওয়াফ ও মানতিক বিষয়ে সুপন্ডিত ছিলেন। মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিতুমীর একজন দক্ষ কুস্তিগীর হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।

      তিতুমীর ১৮২২ সালে হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কাশরীফ যান এবং সেখানে তিনি বিখ্যাত ইসলামি ধর্মসংস্কারক ও বিপ্লবী নেতা সাইয়িদ আহমদ বেরেলীর সান্নিধ্য লাভ করেন। সাইয়িদ আহমদ তাঁকে বাংলার মুসলমানদের অনৈসলামিক রীতিনীতির অনুশীলন এবং বিদেশি শক্তির পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৮২৭ সালে মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিতুমীর চবিবশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি অনুশাসন প্রচার শুরু করেন। তিনি মুসলমানদের শিরক ও বেদআত অনুশীলন থেকে বিরত থেকে ইসলামের অনুশাসন মোতাবেক জীবনযাত্রা পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করেন। বিশেষ করে তাঁতি ও কৃষকদের মধ্যে তিনি ব্যাপক প্রচারকার্য চালান। অচিরেই মুসলমানদের প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং তাদের উপর অবৈধ কর আরোপের জন্য পুরার হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমীরের সংঘর্ষ বাঁধে। কৃষককুলের উপর জমিদারদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতে গিয়ে অপরাপর জমিদারদের সঙ্গেও তিতুমীর সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এসব অত্যাচারী জমিদার ছিলেন গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়।

      এ প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা এবং কৃষকদের নিরাপত্তা দানের লক্ষ্যে তিতুমীর এক মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে তাদের লাঠি ও অপরাপর দেশিয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দান করেন। তাঁর অনুসারী ও ভাগিনেয় গোলাম মাসুমকে বাহিনীর অধিনায়ক করা হয়। তিতুমীরের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে জমিদারগণ তাঁর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ সৃষ্টি এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংরেজদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালায়। গোবরডাঙার জমিদারের প্ররোচনায় মোল্লাহাটির ইংরেজ কুঠিয়াল ডেভিস তার বাহিনী নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং যুদ্ধে পরাজিত হন। তিতুমীরের সঙ্গে এক সংঘর্ষে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার নিহত হন। বারাসতের কালেক্টর আলেকাজান্ডার বশিরহাটের দারোগাকে নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান করে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। এ সময়ে তিতুমীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের নিকট জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় নি।

      তিতুমীর ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে নারকেলবাড়িয়ায় এক দুর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর মুজাহিদ বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক মুজাহিদ নিয়োগ করে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দান করেন। অচিরেই মুজাহিদদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারে উপনীত হয়। সামরিক প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে তিতুমীর নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা দেন এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। অচিরেই তিনি চবিবশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলায় স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিতুমীর তাকি ও গোবরডাঙার জমিদারদের নিকট কর দাবি করলে তারা ইংরেজদের শরণাপন্ন হন। কলকাতা থেকে এক ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয়। কিন্তু ইংরেজ ও জমিদারদের সম্মিলিত বাহিনী মুজাহিদদের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। অবশেষে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কলেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ১০০ অশ্বারোহী, ৩০০ স্থানীয় পদাতিক, দুটি কামানসহ গোলন্দাজ সৈন্যের এক নিয়মিত বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।

      ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ইংরেজ বাহিনী মুজাহিদদের উপর আক্রমণ চালায়। মুজাহিদগণ সাবেকি ধরনের স্থানীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে বাঁশের কেল্লায় আশ্রয় নেয়। ইংরেজরা কামানে গোলাবর্ষণ করে কেল্লা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। বিপুল সংখ্যক মুজাহিদ প্রাণ হারায়। বহুসংখ্যক অনুসারিসহ তিতুমীর যুদ্ধে শহীদ হন (১৯ নভেম্বর ১৮৩১)। মুজাহিদ বাহিনীর অধিনায়ক গোলাম মাসুমসহ ৩৫০ জন মুজাহিদ ইংরেজদের হাতে বন্দি হন। গোলাম মাসুম মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। ১৪০ জন বন্দিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়।

      Professor Answered on April 11, 2019.
      Add Comment
    • RELATED QUESTIONS

    • POPULAR QUESTIONS

    • LATEST QUESTIONS

    • Your Answer

      By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.