প্রভৃতি এবং ইত্যাদি শব্দ দুটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্থক্য কী?
আমরা প্রায়ই লেখ্য ভাষায় প্রভৃতি এবং ইত্যাদি শব্দ দুটি ব্যবহার করে থাকি। বাংলা ব্যাকরণে এই দুটি শব্দ ব্যবহারে কোনো পার্থক্য আছে কি?
ইত্যাদি :
সংস্কৃত ইতি+আদি-র সন্ধির ফলে ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি। ইতি মানে ইহা, শেষ আর আদি মানে প্রথম, খাঁটি মূল বা আরম্ভ। শব্দার্থে ইত্যাদি হচ্ছে ইতি হতে আরম্ভ, অর্থাৎ সম্পূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ। সমাস করলে দাঁড়ায় : ইতি হয়েছে আদি যার।।বহুব্রীহি সমাস। অর্থাৎ এখানেও পূর্ণাঙ্গ। কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে ইত্যাদি মানে ‘এগুলো এবং এরূপ আরো অনেক’। যেমন বাংলাদেশে বাস করে এ ধরনের কয়টি পাখির উদাহরণ দিতে কাক,চিল, বক,শালিক, ময়না, দোয়েল ইত্যাদি। এ বাক্যে ইত্যাদি শব্দে বোঝানো হচ্ছে। ইত্যাদি শব্দটি অব্যয় পদ।
প্রভৃতি :
আমরা জানি ইত্যাদির প্রতিশব্দ প্রভৃতি। প্রভৃতি শব্দটি কখনো বিশেষণ, কখনো অব্যয়। সং প্র+ র(ভৃ)+তি = প্রভৃতি। বিশেষণ হিসেবে প্রভৃতির অর্থ ইত্যাদি, আর অব্যয় হিসেবে এর অর্থ অবধি বা পর্যন্ত। শব্দগত বা ব্যবহারিক দিক দিয়ে প্রভৃতি এবং ইত্যাদি সমার্থক। বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্রের সরল বাঙ্গালা অভিধান, রাজশেখর বসুর চলন্তিকা, সংসদ বাঙ্গালা অভিধান সেরকমই বলে। কিন্তু ইত্যাদি আর প্রভৃতির মধ্যে যে ব্যবধান বা পার্থক্য তা সম্পূর্ণরূপেই প্রায়োগিক। ভাষা শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ইত্যাদি আর প্রভৃতির ব্যবহার সম্পূর্ণ একটা রীতি-র মত চলে আসছে। আজ আর তার ব্যতিক্রম ঘটানো যাবে না, তা নয়। তবে তা হবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের নামান্তর। তাতে ভাষা দীর্ঘদিনের বৈশিষ্ট্যচ্যুত হবে। নষ্ট হবে সৌন্দর্য।
ব্যবহার :
ইত্যাদি আর প্রভৃতির ব্যবহার ব্যাকরণে বহুবচন বাচক শব্দ বা অব্যয়সূচক প্রত্যয় রা,এরা, গণ, গুলি, গুলা, গুলো, বৃন্দ, বর্গ, রাজি, রাশি, সকল, সমূহ, সমুদয়, দল, দাম, নিচয়, নিকর, মালা, আবলী, গোষ্ঠী, যূথ ‘প্রভৃতি’র ব্যবহারিক নির্দিষ্ট নিয়মের মতই। এর যে কোনটি যে কোন বহুবচন বাচক শব্দের শেষে যুক্ত হবে না। যেমন সাধারণত উন্নত প্রাণিবাচক শব্দে ‘রা’ ব্যবহৃত হয়: মুক্তিযোদ্ধারা, ছাত্ররা (কবিতায় অবশ্য ব্যতিক্রম ব্যবহার প্রচলিত)। কিন্তু গণ, বৃন্দ, মণ্ডলী, বর্গ কেবল উন্নত প্রাণিবাচক শব্দের বহুবচনেই ব্যবহৃত হয়। যেমন দেবগণ, জনগণ সুধীবৃন্দ, শিক্ষকবৃন্দ, সম্পাদকমণ্ডলী, মন্ত্রীবর্গ।
তেমনি কেবল অপ্রাণিবাচক শব্দে আবলী, গুচ্ছ, দাম, মালা, রাজি ব্যবহৃত হয়; যেমন শব্দাবলী, গ্রন্থাবলী, অশোক গুচ্ছ, কবিতা গুচ্ছ, শৈবালদাম, কুসুমদাম, পর্বতমালা, পুষ্পরাজি, তারকারাশি। সেক্ষেত্রে জনগুচ্ছ, জনমালা, জনরাশির ব্যবহার নেই তেমনি ইত্যাদি, প্রভৃতির ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। পাল ও যূথ যেমন কেবল জন্তুর জন্য নির্দিষ্ট।
ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় মানবেতর প্রাণী, জড়বস্তুর কয়েকটি উদাহরণের পর। যেমন টগর, বেলি, জবা, কামিনী ইত্যাদি। বই, খাতা, কলম ইত্যাদি।
অন্যপক্ষে প্রভৃতি ব্যবহৃত হয় শব্দ, সাহিত্য, ব্যাকরণ শাস্ত্রের একাধিক উদাহরণের পর। যেমন পৃথিবীতে অনেক মহাকাব্য রচিত হয়েছে। যেমন রামায়ণ, মহাভারত, মেঘদূত, ইলিয়াড, ওয়ার অ্যান্ড পিস প্রভৃতি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ইত্যাদি আর প্রভৃতি-র যুগপৎ ব্যবহার হয়ে থাকে।
প্রমুখ :
ইত্যাদি আর প্রভৃতি-র মত বচনবাচকতা, বহুত্ববাচকতার আরো একটি শব্দ রয়েছে প্রমুখ। ‘প্রমুখ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশেষণ হিসেবে শ্রেষ্ঠ, উত্তম, প্রধান। আর অব্যয়রূপে ইত্যাদি, প্রভৃতি। বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে প্রমুখ আদি, প্রভৃতি, অগ্রণী বা নেতা। সংসদ বাঙ্গালা অভিধান মতে প্রমুখ (সমাসে উত্তরপদরূপে) আদি, প্রথম, প্রধান, প্রভৃতি। যেমন ব্যাস প্রমুখ কবিগণ। ইদানীং সংশোধিত নিয়মে প্রমুখ ব্যবহৃত হলে ‘গণ’ ব্যবহৃত হয় না।
প্রমুখ শব্দটি বহুবাচক এবং ইত্যাদি প্রভৃতির সমার্থক। এটি প্রয়োগক্ষেত্রে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখেছে। এটি যত্রতত্র ব্যবহৃত হয় না। জ্ঞানী, কবি, পণ্ডিত গুণিজনদের বহুবচন বোঝাতে অর্থাৎ উদাহরণে কয়েকজনের নাম দিয়ে, এরূপ আরো আছে বোঝাতে ‘প্রমুখ’ ব্যবহৃত হয়। যেমন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবি বাংলা কবিতাকে নতুন মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যপক্ষে চরিত্রহীন, লম্পট, ছিঁচকে বা সিঁধেল চোর এদের তালিকা অসমাপ্ত হলেও সেক্ষেত্রে ‘প্রমুখ’ বসবে না। যেমন প্রাথমিক তদন্তে অপরাধী হিসেবে যারা তালিকাভুক্ত হয়েছে তারা হল হামিদ, বজলু। এই ‘বজলু’র পরে প্রমুখ ব্যবহৃত হবে না।
অতএব ইত্যাদি, প্রভৃতি, প্রমুখ,শব্দগুলো সমার্থক হলেও ব্যবহারের রীতি অনুসারে এদের ভিন্নতা রয়েছে।