মন ভালো রাখার উপায়গুলি কী?
যখনই, মন ভালো রাখার উপায়গুলি কী কী প্রশ্নটি আসে, সে প্রশ্ন একটা প্রচ্ছন্ন বার্তা ও সাথে করে বয়ে নিয়ে আসে। সে বার্তাটি হচ্ছে, মন খারাপ ও হয়।
বিভিন্ন পরিস্থিতিতেই মন খারাপ হয়। নানা চেষ্টা করেও মন খারাপ হওয়াকে আটকানো যায় না, আবার ধীরে ধীরে, এই মন খারাপ হওয়া শেষ হয়েই যায়, মনে শুরু হয়, ভালো লাগা।
তবে, কিছু কিছু ছোটখাটো প্রচেষ্টা হয়তো তাৎক্ষণিক ভাবে, মন খারাপকে দূরে সরিয়ে, ভালো লাগাকে টেনে নিয়েই আসে।
১। সকাল থেকেই বিষন্ন বদনে বসে আছেন চেম্বারে, আমাদের অফিসের সদালাপী, সদাহাস্যময়, বড়কর্তা।
ছোট অফিস আমাদের, পাঁচ, ছয়জন কর্মী।
সকাল থেকেই, আমরা যারাই কোনো কাজে তাঁর চেম্বারে ঢুকছি, ছিটকে বেরিয়ে আসছি, তাঁর হুংকার শুনে।
এরপর, আমরা তিনচার জন সহকর্মী একসাথেই ঢুকলাম, তাঁর চেম্বারে,
“স্যার, আপনের মন খারাপ ক্যান ? আমাদের বলেন, দেখি, আমরা কিছু করতাম পারি কী না”…,
“Please, নিজের কাজ করুন, আমাকে ডিসটার্ব করবেন না…”
বেরিয়ে এলাম সবাই। কী করা যায় ?
দুপুরে প্রতিদিনই আমরা অফিসের ক্যান্টিনে, সবাই একটু ডাল ভাত খাই। সেদিন, ক্যান্টিনে বড়কর্তার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বারণ করে দিলাম। বড়কর্তার জন্য হোটেল থেকেই আনালাম একটি নয়নশোভন থালি।
দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে, ক্যান্টিন বয় সেই থালি নিয়ে চেম্বারে ঢুকছে, পিছন পিছন, আমরা।
থালি দেখেই, বড়কর্তার বিস্তীর্ণ হাসি, মুখে, “Awesome, really I am proud to have you people as my colleague”।
আমি আবার একটি প্লেটে করে, বড়কর্তার টেবিলে রাখলাম, একটি মিষ্টি পান।
সেটি দেখে, বড়কর্তার উচ্ছ্বসিত বাণী, “No word is there to praise you”
বিকেলের দিকটায় আমরা ক’জন আবার ঢুকলাম বড় কর্তার চেম্বারে। দেখি, মোশন হাই-বেক চেয়ারে প্রায় অর্দ্ধ শোয়া অবস্থায়, চোখ বুজে টেবিলে রাখা ল্যাপটপে চলতে থাকা, “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা”র সাথে দুলকি চালে মাথা দোলাচ্ছেন।
আমাদের দেখেই, সোজা হয়ে বসলেন, “আসুন ভাই, আসুন, বসুন, Any problem ? I stand by you”
আমরা, ”স্যার, সকালে আপনার মন খারাপ দেখে ভালো লাগছিলো না আমাদের…”
তিনি, “কী করবো ভাই ?” এই দেখুন, বলে, তাঁর বাঁ হাতটা দেখালেন,
হাতের কিছু জায়গা ছড়ে গেছে।
আমরা, “স্যার, ক্যামন কইরা হইলো ? টেট ভ্যাক নিছেন ?”
তিনি, “আর বইলেন না ভাই, সকালে অফিসে আসবো, ঠিক ফ্ল্যাট থেকে বেরনোর আগে, আমার ক্রেডিট কার্ড নিয়ে টানাটানি, আঙ্গুলের নখ দিয়ে চিরে ও দিলো, আবার কার্ডটা ও নিয়ে নিলো।”
“কে স্যার ?”
“কে আবার ? আপনাদের সেই মহীয়সী নারী, উইমেন্স ডে তে অফিসে এনে, আপনারা যাঁকে সম্বর্ধনা দ্যান, তিনি, আপনাদের ম্যাডাম… যাক, কী করা যাবে ভাই, সংসারে এসব ঝামেলা হবেই, মন খারাপ কইরা লাভ নাই”
বলেই, টেবিলে তবলা বাজানোর মতো করেই দু’হাতে তাল ঠুকছেন।
কারণ, তখন ল্যাপটপে বাজতে শুরু করেছে, “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে…”
সকালবেলা যে বৃষ্টি ঝরছিল, বিকেলে থেমে গেছে সে বৃষ্টি, দেখা দিয়েছে রামধনু।
বড়কর্তার মন ভালো হয়ে গেছে।
২। মন খারাপ আমার।
মন খারাপের কারণ ?
কারণ, সেদিনই নতুন জুতো কিনে, পায়ে দিয়ে দুপুরে মন্দিরে গেছিলাম প্রণাম করতে। সিঁড়ির নীচে, জুতো ছেড়ে, প্রণাম করে এসে দেখি, জুতো অদৃশ্য…
মন খারাপকে সাথে করে বয়ে নিয়েই, সন্ধ্যেবেলা গেছি এক পরিচিত বাড়ীতে।
গিয়ে বসলাম, তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, “মনটা ভালো না মনে হইতাছে…”
জুতো হারানোর কাহিনী বলা শুরু করবো, তাঁরা সামনে এনে রাখলেন এরকম একটি উপহার।
মন খারাপের কাহিনী আর বলা হলো না।
কর্পুরের মতোই উবে গেছে মন খারাপ। কামড়ে, কামড়ে এসে ধরা দিচ্ছে, কেবলই, মন ভালো লাগা।
৩। উল্টোরথের দিন বিকেলে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতেই, আমাদের বাড়ীতে মন খারাপ করেই এসে বসলেন, আত্মীয়সম এক ভদ্রলোক।
বসে আছেন গম্ভীর মুখে, হঠাত করেই বেজে উঠে তাঁর মোবাইল, এর পরে তাঁর রাগতস্বরে কথোপকথন,
“হ্যালো, আপনে আমার টাকা কবে ফিরত্ দিবেন ? আজকে এত মাস ধইরা আমারে ঘুরাইতাছেন, ভাবছেন কী ? ঘুঘু দেখছেন, ফাঁদ দেখেন নাই, কী করতে পারি আমি জানেন ?”
তাঁর কথার মাঝেই, তাঁর সামনে এনে রাখা হলো, জিলিপির থালা, থালায় খান তিরিশেক জিলিপি।
চলতে থাকা কথার মাঝেই, জিলিপির থালায় তাঁর চোখ পড়তেই দেখলাম, উচ্চগ্রামের কণ্ঠস্বর, মধ্যম নয় নিম্নগ্রামে বইছে। চলছে তাঁর কথা, মিষ্টি স্বরে,
“বুঝি, বুঝি, সবারই সুবিধা, অসুবিধা আছে। যাক চাপ দিতাছি না, ওই চেষ্টা কইরেন টাকাটা দিয়া দেওয়ার, একবারে অসুবিধা হইলে, অল্প অল্প কইরা দিয়া দিয়েন আর কী, খারাপ পাইয়েন না, অনেক কিছু বইল্যা ফেলছি, মন খারাপ কইরেন না, ভাই আমার”
তাঁর মন খারাপ, উবে গেছে।
জুলজুল করে জিলিপির থালার দিকে তাকাচ্ছেন।
শুধু, তাঁর নয়, আমাদের মন ও ভালো করে দেন তিনি।
কেমন করে ?
বলে উঠেন, “আরে সব্বনাশ, এতগুলি ? পারুম না, অসম্ভব। কমিয়ে দেন…”
আমরা, “না, না, এই কয়টা আর এমন কী ? আর আপনে জিলিপি ভালো ও বাসেন, খান।”
তিনি, ” না,না, তাইলে একটা জিলিপি অন্তত কমাইয়া দ্যান, একটা উঠাইযা নিয়া নেন, প্লিজ, বাকী সবগুলিই খামু”।
সুতরাং, কোনো নিয়ম করেই মন খারাপ লাগাকে আটকানো যাবে না। মন খারাপ, হবেই।
তবে, মন খারাপের কারণগুলিকে আঁকড়ে না ধরে, মন ভালো হয় এরকম ব্যাপারগুলিকে আঁকড়ে ধরলে, মন খারাপ পালিয়ে যাওয়ার কথা।
আমি শুধু মন ভালো করার কিছু কথাই বললাম।
এছাড়াও আরো চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, মন ভালো করে দেওয়ার মতো নানা ব্যাপার।
আকাশে ঘুড়ি উড়তে দেখলে মন ভালো হয়ে যায়,
রামধনু দেখলে মন ভালো হয়ে যায়,
নিজের অর্ডার করা পছন্দের জিনিষটি ডেলিভারী দিতে যখন, রাস্তায় থেকেই ক্যুরিয়ার মেন অ্যাড্রেস কনফার্ম করার জন্য ফোন করেন, সেই ফোনে, মন ভালো হয়ে যায়,
ডিসকাউন্টে প্লেনের টিকিট পেয়ে গেলে, মন ভালো হয়ে যায়,
শপিংমলে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে, চোখে চোখ পড়লে, মন ভালো হয়ে যায়,
ধন্যবাদ।