মস্তিষ্ককে শাণিত করে মেডিটেশন

    মস্তিষ্ককে শাণিত করে মেডিটেশন

    Add Comment
    1 Answer(s)

      মানবদেহের সবচেয়ে দুর্জ্ঞেয় ও রহস্যময় অঙ্গ কোনটি? উত্তরটা বুঝি সবারই জানা- আমাদের ব্রেন বা মস্তিষ্ক। এ নিয়ে তাই বিজ্ঞানীদের গবেষণা আর উৎসাহের অন্ত নেই কোনো। সময় যত যাচ্ছে মস্তিষ্কের জটিল কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীদের মনে রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে।

      মানুষের ক্ষমতা সত্যিই অসীম এবং এটি নির্ভর করে মস্তিষ্ককে আমরা কতটা চমৎকারভাবে ব্যবহার করতে পারছি, তার ওপর। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আমাদের বুদ্ধিমত্তা কিভাবে কাজ করে বা এটি কোন প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হয় তার আধখানা হদিসও যদি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়, তবে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর উপায় জানাও সম্ভব হবে।
      পেশিশক্তি বাড়ানোর আশায় অনেকে ভারোত্তোলন আর নানারকম শক্ত ব্যায়াম করে থাকেন। এর ফলে পেশির শক্তি বাড়ে ঠিকই, কিন্তু কিভাবে? গবেষণায় দেখা গেছে, এতে পেশির কোষগুলোর মধ্যে এক ধরনের রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক আন্তঃপারস্পরিক যোগাযোগের সৃষ্টি হয়। ফলে পেশিতন্তুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পেশি হয়ে ওঠে অধিকতর শক্তিশালী ও মজবুত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাও আসলে বাড়ানো সম্ভব এভাবেই- মস্তিষ্কের কোষ অর্থাৎ নিউরোনগুলোর মধ্যকার আন্তঃপারস্পরিক সংযোগ বাড়িয়ে। এতে মস্তিষ্কের সম্ভাবনা বাড়ে বহুগুণ। গবেষকদের মতে, এর অন্যতম উপায় হলো মেডিটেশন বা ধ্যান। যার মাধ্যমে মস্তিষ্ককে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে আমরা হয়ে উঠতে পারি আরও চৌকস, আরও সৃজনশীল আর তীক্ষ্ণধী।

      আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটে চলেছে, সেসব ঘটনার আদ্যোপান্ত অনেকেই বেশ দ্রুত আর সহজে বুঝতে পারেন। নিঃসন্দেহে এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন মানুষের মস্তিষ্ক কতটা তীক্ষ্ণ ও উর্বর, সেটি বোঝা যায় মূলত এই বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি দিয়েই। তাই এটা বাড়ানোর উপায় নিয়ে চলছে বিজ্ঞানীদের নিদ্রাহীন গবেষণা।

      এ প্রসঙ্গে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ-ওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের গবেষক জেমস বিব বলেন, প্রচুর তথ্য-উপাত্ত ও একাধিক গবেষণার ভিত্তিতে বিষয়টি আমাদের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
      কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্টিস্ট ইয়াকভ স্টার্ন বলেন, মূলত নিউরোন ও সিন্যাপ্সের (দুটি নিউরোনের মধ্যবর্তী সংযোগ-পথ) সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতেই রচিত হয় উচ্চস্তরের বুদ্ধিমত্তা। অর্থাৎ নতুন নতুন নিউরোন ও সিন্যাপ্সের উৎপত্তির ওপর নির্ভর করে আমাদের বোঝার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও সৃজনশীলতা।
      স্টার্নের নিউরো-ইমেজিং গবেষণায় দেখা যায়, একজন মানুষ কোনো একটি বিশেষ কাজে দক্ষ হয়ে উঠলে সে কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট মস্তিষ্কের সেই বিশেষ অংশের নিউরোনের সংযোগ-পথগুলো হয়ে ওঠে অধিকতর প্রশস্ত, নমনীয় এবং কার্যকরী।

      মস্তিষ্কের কাঠামো ও কর্মপ্রক্রিয়া উন্নত করার উপায় নিয়ে পরিচালিত অনেকগুলো গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা বলেন, এর একটি জাদুকরী প্রক্রিয়া হচ্ছে মনোযোগ, যা মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তন করতেও সক্ষম। পর্যাপ্ত মনোযোগের মাধ্যমে নিউরোনগুলোর মধ্যকার বৈদ্যুতিক সংযোগ-পথ হয়ে ওঠে আরো বিস্তৃত। এটি বোঝানো হয়েছে একটি উদাহরণ দিয়ে। যেমন- গভীর মনোযোগে একটি সুর যদি ক্রমাগত শোনা হয়, মস্তিষ্কের যে অংশের মাধ্যমে এটি অনুভূত হয় তা ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে। আর মূলত এ মনোযোগই কোনো একটি কাজে আমাদেরকে দক্ষ ও চৌকস করে তোলে।

      কাজে মনোযোগ বাড়ানোর জন্যে ধূমপানের পক্ষে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নানারকম সাফাই গেয়ে থাকেন ধূমপায়ীরা। কিন্তু গবেষকদের সাবধান বাণীটা একটু অন্যরকম-সিগারেটে থাকা নিকোটিন বরং স্মৃতিভ্রষ্টতার ঝুঁকিই বাড়ায়। এছাড়াও ব্রেনে ডোপামিনের প্রবাহ বাড়িয়ে স্মৃতিশক্তিকে উদ্দীপিত করার জন্যে ইদানীং কিছু কিছু ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট মার্থা ফারাহ্ পরিচালিত একটি গবেষণায় একদল স্বেচ্ছাসেবককে দুটি গ্রুপ ভাগ করে এক গ্রুপকে এসব ওষুধ সেবন করানো হয় আর অন্য গ্রুপকে শুধু প্লাসিবো অর্থাৎ ইতিবাচক বিশ্বাসে উজ্জীবিত করা হয়। পরবর্তীতে দুটি দলের কর্মদক্ষতায় ফারাহ্ কোনো পার্থক্য খুঁজে পাননি। এ গবেষণার ফলাফলে তিনি বলেন, ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে ডোপামিনের প্রবাহ বাড়িয়ে আপনি নিজেই আপনার ব্রেনকে উদ্দীপ্ত করতে পারেন। উপরন্তু ইতিবাচক চিন্তার ফলে আপনার বিশ্বাসের শক্তি বাড়বে, যা কখনো ওষুধের মাধ্যমে সম্ভব নয়।

      স্ট্রেসমুক্ত থাকুন সবসময়। স্ট্রেস আপনার মস্তিষ্কের নিউরোনের ক্ষতির কারণ। স্ট্রেসের ফলে নিঃসৃত কর্টিসোল হরমোন নিউরোনের আবরণ মায়েলিন শিথ্-কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেবল তা-ই নয়, নিউরোনগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক যোগাযোগকেও বাধাগ্রস্ত করে তোলে কর্টিসোল। তাই বিজ্ঞানীরা বলেন, স্ট্রেসমুক্ত থাকতে পারলে মস্তিষ্কের সম্ভাবনাকে আপনি বহুগুণে বাড়াতে পারবেন।

      মস্তিষ্ককে যত বেশি পরিমাণে ব্যবহার করবেন এর শক্তি ও সম্ভাবনা তত বাড়তে থাকবে। ২০০৩ সালে লন্ডনের ক্যাব ড্রাইভারদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় এর প্রমাণ মিলেছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নিউরোসায়েন্টিস্ট এলিনর মেগার এ গবেষণার মাধ্যমে দেখান যে, যারা লন্ডন শহরের সবচেয়ে গোলমেলে রাস্তাগুলোর গলি-ঘুপচি চমৎকারভাবে মনে রাখতে পারেন, তাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অন্যান্য ক্যাব ড্রাইভারদের তুলনায় আকারে বিস্তৃত। তার মতে, মস্তিষ্ককে এভাবে ব্যবহার না করলে আমরা ক্রমাগত এ ক্ষমতা হারাতে থাকব।

      বিজ্ঞানীরা বলছেন, মস্তিষ্ককে শাণিত করে তোলা সম্ভব আমাদের সবার পক্ষেই। এজন্য প্রথমত প্রয়োজন মেডিটেশন। কারণ মস্তিষ্কের যে অংশটি আমাদের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মিত মেডিটেশনে তার পুরুত্ব বাড়ে। আর কাজে মনোযোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে আমাদের কর্মদক্ষতা। মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্টিস্ট আমিশি ঝা বলেন, মেডিটেশনের প্রভাবে মনোযোগ বাড়ে এবং আমাদের মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো পরিবর্তিত হয়। আমরা হয়ে উঠি আগের চেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত, চৌকস ও কর্মতৎপর।

      মস্তিষ্ককে শাণিত করার দ্বিতীয় কার্যকরী উপায়টি হলো ব্যায়াম। তড়িঘড়ি এখনই জিমে ছুটতে হবে এমন নয়, বরং ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ আদর্শ। আর এ-ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হলো হাঁটা। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আর্ট ক্রেমারের মতে, সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ৪৫ মিনিট করে হাঁটলে আমাদের স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। কারণ ব্যায়ামের ফলে নিউরোনের সুস্থতার জন্যে প্রয়োজনীয় নিউরোট্রান্সমিটারগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। সেই সাথে মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশে বাড়ে গ্রে-ম্যাটার বা ধূসর পদার্থের পরিমাণ। উল্লেখ্য, মস্তিষ্কের এই প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স থেকেই উৎসারিত হয় আমাদের সুখ ও আনন্দের মতো ইতিবাচক আবেগ-অনুভূতিগুলো।

      এছাড়াও নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে নতুন সিন্যাপ্সের উৎপত্তি ঘটে এবং নিউরোনগুলোর মধ্যে ত্বরিত যোগাযোগ সুদৃঢ় হয়। শাণিত বুদ্ধিমত্তা অর্জনের জন্যে যা অত্যন্ত প্রয়োজন। ক্রেমার বলেন, নিউরোনগুলোর মধ্যে সংযোগায়নের এ প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, এর ফলে স্মৃতিশক্তি, পরিকল্পনা-দক্ষতা এবং একসাথে অনেক কাজ সামলানোর ক্ষেত্রে একজন সত্তরোর্ধ্ব মানুষের মস্তিষ্কও হয়ে ওঠে ৩০ বছরের তরুণ মস্তিষ্কের মতোই তুখোড় ও সৃজনশীল।

      Professor Answered on December 3, 2023.
      Add Comment
    • RELATED QUESTIONS

    • POPULAR QUESTIONS

    • LATEST QUESTIONS

    • Your Answer

      By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.