মানুষের মাঝে হিংস্রতা কেন আসে?
এই প্রশ্নের উত্তরটি ঠিক কতটা সহজে দেওয়া যাবে জানিনা। আসলে প্রতিদিন খবরের কাগজ বা টেলিভিশন অথবা যে কোনো সামাজিক মাধ্যমে মানুষের হিংস্রতা, নির্মমতার যে নিদর্শন প্রতি মুহূর্তে দেখতে পাই তার কারণ বিশ্লেষণ করার মত সময় বা কৌতূহল কোনোটিরই প্রাচুর্য্য আমাদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। আমার মতে অনেক সময় এই হিংস্রতার পেছনে অন্ধ কুসংস্কারের একটি ভয়ানক ভূমিকা থাকে। সংবাদ মাধ্যমের খবরের ওপর নির্ভর করে কোনো উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া কোনো সময় অতি – সরলীকরণও হয়ে যেতে পারে।
মানুষের হিংস্রতা কে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বহু মানুষ নর্সিসিজম এবং সহানুভূতির অভাবকে দায়ী করেছেন, যদিও নার্সিসিজম অনেক ক্ষেত্রে একটি সহজাত প্রবৃত্তি।
ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন sadism বা অন্য মানুষকে দুঃখ দিয়ে যে আনন্দপ্রাপ্তি হয় তার পেছনে কোথাও একটা অতৃপ্ত যৌন চাহিদা এবং আগ্রাসন কাজ করে। তাঁর মতে, যৌনতা, রাগ, ক্রোধ অথবা নিষ্ঠুরতা সবই মানুষের সহজাত স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে এই আদিম রিপুগুলিকেই মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। তাই এই সহজাত ইম্পালসের বশবর্তী হয়ে যে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং তা প্রতিটি মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। শুধু পার্থক্য একটাই, কিছু ব্যাক্তি এই basic instinct গুলিকে অন্যদের তুলনায় বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আর কেউ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়।
Heinz Kohut ছিলেন একজন বিখ্যাত সাইকো – অ্যানালিস্ট যিনি “সেলফ সাইকোলজি” নামে একটি তত্ত্ব প্রবর্তন করেন। তাঁর মতে যে কোনো মানুষের অন্য মানুষের প্রতি রাগ, ক্রোধ অথবা ঘৃণার মতো সংবেদনশীল অনুভূতিগুলোর একটি ইমোশনাল এবং সাইকোলজিকাল কারণ থাকে যদিও তা সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে ব্যখা করা সম্ভব না। হিংস্রতা, রাগ, আগ্রাসন এই সমস্ত কিছুর কারণ হিসাবে তিনি “fragmentation” কে দায়ী করেছেন। অর্থাৎ কোনো মানুষ যখন তার কাছের কোনো মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, নিজেকে বোঝাতে বা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয় অথবা কোনো কারণে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হলে তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া স্বরূপ রাগ বা হিংস্রতা জন্ম নিতে পারে।
ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী এবং লেখক ক্রিস্টোফার বোলাস বলেছেন যে বিদ্বেষ ও ঘৃণ্য আচরণের নীচে একটি গভীর শূন্যতাবোধ রয়েছে এবং ক্রোধ, ঘৃণা এই শূন্যতা পূরণ করার একটি উপায় মাত্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী রুথ স্টেইন সন্ত্রাসবাদীদের মনোবিজ্ঞান কে খুব সুন্দর ভাবে ব্যখা করেছিলেন। তাঁর মতে, সন্ত্রাসবাদীরা নিজেদের গভীর আত্ম বিদ্বেষী মনোভাব থেকে রক্ষা পেতে অথবা নিজেদের কাজকে জাস্টিফাই করার জন্য সর্বোচ্চ কোনো সত্বাকে আদর্শ মনে করে এবং ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে সহস্র মানুষকে হত্যা করে। ধর্মীয় নৈতিকতার ভিত্তিতে যে আঘাত বা নিষ্ঠুরতার পরিচয় মানুষ দিয়ে থাকে সে ক্ষেত্রেও এই মনোভাব প্রযোজ্য।
অনেক সময় দেখা যায়, যে শিশুটি তার শৈশবে মানসিক বা শারীরিক ভাবে ভয়ংকর নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছে সেই পরবর্তীকালে হিংস্রতা বা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে একাধিকবার। আবার সবক্ষেত্রে যে তা সত্য এমনটাও নয়। তাই মানুষের রাগ, দুঃখ, ক্রোধ, হিংসা অথবা নিষ্ঠুরতা ঠিক কেন আসে তা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা সাইকোলজিকাল কারণ থাকতে পারে। তবে মানুষের এই অনুভূতি কিন্তু বর্তমান সভ্যতার ফসল নয়, বরং তা সৃষ্টির আদিম যুগ থেকেই ছিল।