মানুষ কেন আশা করে?
ওই যে ওপরের জানালায় একা বসে আছে রক্তিম এই সদ্য কয়েকমাস আগেই ওর চাকরিটা চলে গেছে।কাজটা বেশ ভালোই ছিলো মাস গেলে মোটা মাইনেও পেতো কিন্তু নতুন ম্যানেজার এসে কিছুজনকে বাতিল করে দিলো, রক্তিম তাঁদের মধ্যে একজন । মাসের শেষে বাড়িতে কি করে টাকা পাঠাবে ও জানে না।
অনেকদিন ধরে বাড়ির লোকজনের সাথে নিজেদের সম্পর্ককে নিয়ে অনেক লড়াই করে রেজিস্ট্রির জন্য রাজী করাতে পেরেছে নীলিমা আর সুজন। প্রায় স্কুল জীবন থেকে ওদের প্রেম। দুজনে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে একসাথে থাকবে এই ভেবেই এতদিন ছিলো ওরা। দুজনের বাড়ির লোকজন প্রথমে আপত্তি করলেও পরে ওদের একসাথে থাকার ইচ্ছের কাছে সবাইকে হার মেনে নিতেই হয়।
পাঁচমাস ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছে সায়নী। ডাক্তারি নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ওর কোনোদিন ছিলো না আজও নেই তবে বাবার ইচ্ছের জন্য ওকে ডাক্তারী নিয়েই পড়তে হচ্ছে। সায়নী ফটোগ্রাফার হতে চাই কিন্তু বাড়ি থেকে কোনো সাপোর্ট পাচ্ছে না আর ডাক্তারী নিয়ে পড়তেও সে পারছে না। সায়নী জানে এতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ও নয় বাবার কথামতো যদি ও 89% মার্কস না পায় তাহলে বাড়িতে ও যেন আর ফিরে না যায়।
ছোটবেলা থেকেই মিউসিক ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে বিভাসের ভীষণ আগ্রহ। বড়ো হয়ে নামকরা মিউজিশিয়ান হবে এটাই ছিলো তার একমাত্র স্বপ্ন তার জন্য সে সেভাবে পড়াশোনা করলেও চাকরির চেষ্টা কোনোদিন করেনি। একটা প্রাইভেট অফিসে কাজ করে আর প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে এক একটা মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে ফেলে। আজকে অনেকদিন পর অফিসের একটা প্রোগ্রামে বিভাস ওর প্রিয় সাক্সফোন বাজাবে সেই জন্য বিভাস ভীষণ খুশি।
সাত-আট বছরের সম্পর্কের পর মৃণালিনী ভেবেছিলো সম্পর্কের বিচ্ছেদের ভয় আর ওর নেই। সেই কারণে বাড়িতেও নিজের সম্পর্কের কথা বাড়িতে জানিয়ে দেয়। দুদিন আগে মৃণালিনী জানতে পারে রাহুলের বাড়ির লোকজন ওদের সম্পর্ক মেনে নিচ্ছে না তাই ও মৃণালিনীকে বিয়ে করতে পারবে না। বাড়িতে যে মেয়েকে ঠিক করেছে ও তাকেই বিয়ে করবে। মৃণালিনী সত্যিই জানে না এই ভেঙে যাওয়া সময়টা সে কি করে সামলাবে।
বাচ্চার নাম কি দেওয়া হবে, বাচ্চা কোন স্কুলে পড়বে, নাচ শিখবে নাকি গান শিখবে, ওরা দুজন মিলে খুব ভালোভাবে ওদের বাচ্চাকে বড়ো করবে এই সমস্ত কিছু কথা প্রেগনেন্সির সময় থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো নীলা। কিন্তু মেয়ে হওয়ার একবছর পর তিনদিনের জ্বরে মারা যায় নীলা। ওর শরীর খারাপ করছে বা কষ্ট হচ্ছে এসবের কোনোকিছুই ও কোনদিন শুভকে জানায়নি। শুভ যখন জানতে পারলো তখন ওর করার কিছুই ছিলো না।
নিজের বড়ো বিজনেজ রক্তিমের আর বিজনেজ ওর খুব ভালোভাবেই এগোচ্ছে, ওর কাছে কোনোকিছুর অভাব নেই পছন্দের গাড়ি, দু-তিনখানা বাড়ি ফ্ল্যাট, প্রচুর সম্পত্তি সব আছে ওর কাছে এককথায় যাকে বলে পারফেক্ট লাইফ। তবে পারফেক্ট বলে কিছু হয় না ঠিক সেরকম ওর জীবনেও ইম্পারফেক্ট বলতে মানুষের অভাব। সারাদিনের কাজ সেরে আসার পর দুটো কথা বলার মানুষের খুব অভাব ওর জীবনে।
নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ঋষিকে ভীষণ ভালো লাগে তুহিনার।মনে মনে ঋষিকে ভালোবেসেও ফেলেছিলো তুহিনা তবে সাহস করে কোনোদিন বলতে পারেনি বলার পর যদি ঋষি ওকে রিজেক্ট করে দেয় আর ওর সাথে কোনো কথা না বলে সেই ভয় ওকে কিছুতেই কিছু বলতে দেয়নি কিন্তু ঋষিও মনে মনে তুহিনাকে বেশ পছন্দ করে। আজকে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছিলো তাই ঋষি তুহিনাকে নিজের থেকেই বলে যে ও তুহিনাকে ওর ফ্ল্যাট পর্যন্ত গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তুহিনা এক-দুবার না বলার পর আর না করেনি। ফ্ল্যাটের দরজার কাছে তুহিনাকে নামিয়ে দেওয়ার পর ঋষি তুহিনার হাত ধরে ওকে নিজের মনের কথা বলে।
স্ত্রী মারা যাবার পর রায় বাবুর যত উদ্ভট উদ্ভট ইচ্ছে শুরু হয়। সারাদিন ঘরে একা থাকে তাই নিজের কাজ সেরে নেওয়ার পর সময় থাকে বিস্তর। ওই সময়ে উনি কি করবেন বুঝতে পারেন না তাই কোনদিন খুব জোরে কীর্তন চালিয়ে দেন কোনোদিন নিজেই জোরে জোরে কীর্তন করেন। এই কিছুদিন হলো উনি একটা পিয়ানো কিনেছেন আর প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা বেসুরে ভীষণ জোরে জোরে পিয়ানো বাজান। ফ্ল্যাটের সবাই অন্যদিন খুব বিরক্ত হয়ে যান অনেকেই ওনার নামে কমপ্লেইন করেন তবে আজকে এই বৃষ্টির সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটের সবার যেন ওনার বেসুরে পিয়ানোর আওয়াজটাও খুব মিষ্টি সুর লাগে।
এই এতো বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি সেখানে এতগুলো ঘর এতগুলো মানুষ, সবার জীবনে এক একটা গল্প অথচ এক ছাদের নিচে থেকেও কেউ কারোর মনের খোঁজ রাখে না।
লেখক: রিমা🌸
ছবি ও লেখা সংগৃহীত