মানুষ ধর্মান্তরিত হয় কেন?
বন্ধু নাসির উদ্দিন জানাচ্ছেন মানুষ কেন ধর্মান্তরিত হয় :
সাধারণত ধর্মান্তরিত হওয়াকে ধর্ম বদল বলা হয়। কারণ, ধর্ম সৃষ্টির পূর্বে মানব জাতি প্রকৃতির শুধু মানুষই ছিল- এই ইতিহাস পৃথিবীতে অনেকে– অনেক ভাবে জানে অথবা ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসে বিশ্বাসী । আমরা বিশ্বাস করি ঐশ্বরিক ভাবে ধর্ম সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এসেছে, সাথে দুই আদি মানব । মানুষ আগমন হোক বা প্রকৃতির সৃষ্টি হোক সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় আদি মানব যাযাবর ছিল অর্থাৎ বনের পশুরা যেভাবে ঘুরে ঘুরে শিকার ধরে আহার করে এবং রাতে নিরাপদ একটি স্থান খোঁজে ঘুমায়- তৎরূপ আদি মানুষেরা সারাদিন খাদ্যের সন্ধানে দলবদ্ধ ভাবে হেঁটে বা দৌড়াদৌড়ি করতো এবং রাতে গুহায় বসবাস করত।
পরবর্তী গোত্র ভিত্তিক সমাজ সৃষ্টির নব্য সভ্যতা সূচনা করেছিল আদি মানুষ এবং নিজেদের মধ্যে ভাষা, বাড়ি ঘর নির্মাণ সহ বিভিন্ন নিয়ম শৃঙ্খলা ক্রমান্বয়ে রপ্ত করেন । এভাবেই মানব সমাজে একদিন অগ্রগামী মানুষ দ্বারা ধর্ম বিধান গুলো সৃষ্টি হয়ে আসে (সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় ) অথবা ঐশ্বরিক ভাবে আগমন ঘটে (আমরা ধর্ম বিশ্বাসীর মতে )। যাক, আলোচনার বিষয় হচ্ছে- ধর্ম কারা বদল করে, কেন বদল করে এবং নাস্তিক বা ধর্মহীন হয়ে যাওয়া মানুষ গুলোও এক ধরনের ধর্ম বদল পর্যায়ে পড়ে।
ভারতবর্ষের বাঙালি মুসলমান গণ নিম্ন বর্ণ বা শূদ্র জাতি থাকা অবস্থায়- সেসময় উচ্চ বর্ণ ব্রাহ্মণ শাসন দ্বারা বা ধর্মীয় অবজ্ঞা আচরণের কারণে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। এ ইতিহাস সবার জানা।
এবার বান্দরবান পার্বত্য এলাকার নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ভাই-বোনদের ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আমি দীর্ঘ 35 /40 বছর ধরে বান্দরবানের পার্বত্যাঞ্চলের পাড়া মহল্লায় ব্যবসায়ীক কারণে যাতায়াত করেছি । ওনাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি একদম নিকট থেকে দেখেছি। অধিকাংশ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ত্রিপুরা, খুমী, বম, সহ বেশ কয়েকটি সম্প্রদায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। অবশ্য তার আগে ধর্ম বদল করলেও হাতে গোণা দুই এক পরিবার। আমার কথা সত্যতা প্রমাণের জন্য নিজের দেখা একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরার প্রয়োজন আছে মনে করি।
তখন 1987 সাল। বান্দরবান বালাঘাটা বাজারের উত্তর মাথা হয়ে চড়ই পাড়া রোডের শেষ প্রান্তে (প্রায় তিন /চার কিঃ) ছড়ার উপর একটি পাকা ব্রীজ ছিল। শুনেছি,বৃটিশ যুদ্ধের সময় পরিত্যক্ত এটি। সাথে লাগান একটি ত্রিপুরা পাড়া। আমি প্রথম যেদিন গেলাম পাড়ার মুখে একটি বেড়ার তৈরী নতুন ঘর দেখলাম। উক্ত এলাকায় আমি একটি গাছের বাগান কিনেছিলাম, যা শ্রমিক লাগিয়ে কর্তন করতে প্রস্তুতিপর্ব চলছিল । যাক, উল্লেখ্য নতুন ঘরে আগ্রহ নিয়ে আমি ঢুকে প্রশ্ন করতেই একজন পুরুষ ত্রিপুরা বললেন, এটি নোয়া (নতুন ) ধর্ম ঘর। আমরা নোয়া ধর্ম পাইয়ে। বিকেলে মৌলভী আইবো।
মূল ঘটনা নিম্ন রূপ। চন্দনাইশ, ধোপাছড়ির একটি ত্রিপুরা পাড়ার কিছু পরিবার (সম্ভবত দাঁতভাঙা পাড়া ) ইসলামী ফাউন্ডেশন বান্দরবান এর মাধ্যমে ধর্মান্তরিত মুসলমান করে ঐ জায়গায় নতুন পাড়া নাম দিয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। এদের ব্যক্তি নামকরণ হয়, রহিম ত্রিপুরা, করিম ত্রিপুরা, রেহানা ত্রিপুরা, মরিয়ম ত্রিপুরা ইত্যাদি। আমি আগ্রহ নিয়ে বিকাল পযর্ন্ত অপেক্ষা করলাম।
একজন চল্লিশ উর্ধ্ব বয়সী বাঙ্গালী মুসলিম মৌলানা এসে উপস্থিত হলেন । পাড়ার নারী পুরুষ সবাই ধর্ম ঘরে (মক্তব বলা যায় ) এসে ঢুকলো। সন্ধ্যার আগ পযর্ন্ত ক্লাস চলেছে। আমি হুজুরকে বললাম, আপনি যে শুকর মাংস না খেতে বললেন,শুকর লালন পালন বন্ধ করতে বললেন এবং নারীদের ইসলামী পোশাক পরিধান নিয়ম শিক্ষা দিলেন; ওনাদের জন্য আগে উন্নত বিকল্প ব্যবস্থা না করে এটা কি করে সম্ভব হবে? আপনি সূরা ফাতিহা বা অন্যান্য সূরা শিখালেন এটি ঠিক আছে। কারণ কারো সংস্কৃতি এবং খাদ্য অভ্যাস দিনে দিনে পরিবর্তন করা যায় না।
হুজুর আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, আপনি ইসলামের কি বুঝেন, কি জানেন?
1997/98 সাল। বান্দরবান রুমা সড়কের পাশ ঘেঁষে বেতছড়া ত্রিপুরা পাড়া। তীব্র শীতের কারণে আমি পাড়ায় রাত যাপন করতে বাধ্য হলাম। আমার বাহন বাইকটিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে রেখে কারবারীর মাচাং ঘরে ওঠলাম। সম্মুখ কামরার এক পাশে গিলাপ কম্বল পেচিয়ে শুয়ে- ঘুমিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম ।অন্য পাশে কারবারী শুয়ে আছে। তাকে সবাই নাউন্নার বাপ বলে ডাকে, আমিও ঐ নামে ডাকি। আমরা দুই জনের মধ্যে গল্পকথন চলছে, তবে লটকানো হারিকেনের আলো নিবু নিবু ছোট আলো দেয়া ছিল। কথা প্রসঙ্গত এক পর্যায়ে উল্লেখ্য 1987 সালের রহিম ত্রিপুরাদের পাড়ার কথা চলে এলো। আমি পুরাতন ইতিহাস তুলতেই নাউন্নার বাপ বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে হারিকেনের আলো বড় করে দিলো। বৃদ্ধ আঙ্গুল উচিয়ে বললেন ” আঁইত ঐ পাড়ার কালাম ত্রিপুরা ছিলাম। সেই যা’ জানালেন তা’ নিম্নোক্ত হুবহু ।
ভালো জীবনের জন্য ওরা ইসলামী ফাউন্ডেশনের সিড়ি মাড়িয়ে বিশ / ত্রিশ পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাদেরকে পাড়া থেকে দশ /বার মাইল পূর্বে জঙ্গল বেষ্টিত উক্ত এলাকায় নিদিষ্ট জায়গা নিয়ে একটি নব্য মুসলিম পাড়া সৃষ্টি দেয়। প্রথম প্রথম আর্থিক সাহায্য পৌঁছনো হলেও তৎ পরবর্তী বর্ষার সময় কেউ খবর রাখেননি। এতে ওনাদের ধারণা হয়েছিল, মৌলানা সাহেব যিনি ওখানে ওনাদের জন্য সাহায্য নিয়ে যেতেন তিনি সব রিলিফ খেয়ে ফেলেছেন। প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য ওনাদের পাড়ায় কোন সচেতন শিক্ষিত লোক ছিলেন না।
পরবর্তী সময় খ্রিস্টান মিশনের আর্থিক সুযোগ সুবিধা ভালো পাবেন নিশ্চিত হতে পারলে সবাই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন অতঃপর বেতছড়া নামক স্থানে চলে আসেন।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী গুলোকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে খ্রিস্টান ধর্মীয় মিশন গুলোর আর্থিক বড় খরচ নিয়ে ব্যাখ্যা আমি করতে পারবো না। তবে এ নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী গুলোকে জঙ্গল থেকে টেনে এনে শিক্ষিত করা, বিভিন্ন ক্ষেত খামার বা ফলজ বাগান করার সফলতা গুলোর পেছনে খ্রিস্টান ধর্মীয় মিশনের অবদান অনেক আছে।