সবচেয়ে বেশি সুখ কিসের মধ্যে পাওয়া যায়?
সবচেয়ে বেশি সুখ কিসের মধ্যে পাওয়া যায়?
সুখ না খোঁজার মধ্যেই সবচেয়ে বেশী সুখ পাওয়া যায়।
আমি যখন কলেজে পড়ি তখন ভাবতাম ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউতে চাকরীটা পেয়ে গেলেই ব্যাস, আমি রাজা, ভুল ভাঙ্গতে বেশী সময় লাগেনি, যখন প্রেম করেছি তখন ভেবেছি দৈহিক সুখই বুঝি সব, দেখলাম তাও ভুল। যখন একটু উঁচু পদে উঠছি ভাবলাম এই যে ক্ষমতার অধিকারী হলাম— এই বুঝি সুখ, নাহ, তাও ভুল। প্রথমবার বিদেশ যাবার আগের রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি, ভেবেছিলাম, ব্যাস, আজ রজনী অতিক্রান্ত হলেই কাল দেশ ছেড়ে বহুদুরের ইউরোপ যাবো, এই তো সুখ!! নাহ, তৃতীয়বারেই ভুল ভাঙ্গল। প্রথম নিজের রোজগারের ফ্ল্যাটে ঢোকবার সময় গৃহপ্রবেশের দিন মনে হোল এই তো সেই দিন যা বাবার থেকে পকেটমানি নেওয়ার সময় থেকে চেয়ে এসেছি- না, তাও পেলাম না সেই কাঙ্খিত সুখ। আর আমি এও জানি কাল সন্তানের যখন বুদ্ধি পাকবে, বাবা-মার ছত্রছায়া ছেড়ে ওর নিজস্ব জগত তৈরি হবে সেদিনও আসবে মনস্তত্ত্বের টানা-পোড়েন। স্নায়ু-পীড়া কি সুখ? না, বোধহয় না।
কি ভাবছেন? বায়রনীয় অ-সুখ?
নাহ, কোথায় বায়রন, কোথায় আমি। তবে এটুকু বুঝেছি মানুষ স্বভাবগতভাবেই বহু কু-প্রবৃত্তির সমাহার। কি কারনে মানুষ অসুখী সেটুকুর সামান্য অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত করেছি। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ কী আমার চাওয়া, তা জানতে পারার জন্যে। এইভাবে ধীরে ধীরে অনেকগুলি উপভোগ্য বস্তুর দখল প্রতিষ্ঠা করেছি। আর এর জন্যে অংশত দায়ী হচ্ছে কিছু কামনার বস্তুকে সফলভাবে ত্যাগ করতে পারা, যেমন কিছু বিষয়ের নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যে, সব কিছু অর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মুলত যা অসম্ভব বলে মনে করেছি তা-ই ত্যাগ করেছি। আমার এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ এই যে, আমি নিজের সম্বন্ধে ভাবনা কমিয়ে দিতে পেরেছিলাম। নিজেকে মনে হত, এবং যথার্থই মনে হত, আমি একটা হতভাগ্য উদাহরণ। ধীরে ধীরে আমার নিজের বিষয়ে, আমার ভুল-ত্রুটির বিষয়ে উদাসীন থাকতে শিখলাম। আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বাইরের বস্তুতে ঘনীভূত করতে আরম্ভ করলাম। যা হচ্ছে চলমান দুনিয়ার অবস্থা, জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা আর স্নেহভাজন সহমর্মী ব্যক্তিরা। বাইরের জিনিসে মন দিলে অবশ্য সেসব আবার তাদের নিজস্ব ধরনের সম্ভাব্য মনোবেদনা বয়ে আনে। কিন্তু এই রকম মনোযন্ত্রণা জীবনের উৎকর্ষকে নষ্ট করতে পারে না, যেমন পারে নিজের প্রতি ঘৃণাজাত বেদনা। বাইরের প্রত্যেকটি কাজে অনুসন্ধিৎসা যে কোনও কাজে উৎসাহ দেয় এবং সেই অনুসন্ধিৎসা যতদিন সজীব থাকে ততদিন তা সম্পূর্ণভাবে অবসাদকে প্রতিরোধ করার কাজে লাগে। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কৌতূহল অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও প্রেরণার সঞ্চার করে না।
তাই বলে নৈরাশ্যবাদকেই জীবনের পাথেয় করিনি, অতৃপ্তির মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনেক এবং নানা ধরণের । কিন্তু তাদের মধ্যেও একটা মিল আছে। জন্ম-অসুখী তাকেই বলা হয় যে প্রথম জীবনে কোনও স্বাভাবিক কামনার সহজ পরিতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরে সেই একটিমাত্র কামনার পরিতৃপ্তিকেই অন্য আর সব কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সে তার জীবনকে একটিমাত্র দিকেই চালিত করেছে। কামনার সাথে প্রস্তুতির ওপরেই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে, তার সাথে যুক্ত আনুষাঙ্গিক উপকরণসমূহকে অগ্রাহ্য করে। বর্তমানে আর এক নতুন ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, কোনও ব্যক্তি নিজেকে কোনও বিষয়ে অতি পরাজিত মনে করার ফলে কোনও পথেই তৃপ্তিকে খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেছে চিত্তবিক্ষেপ আর বিস্মৃতিকে। এরপর সে সহজ আনন্দের অনুসারী হয়ে উঠবেই। এর অর্থ হল সে নিজেকে অর্ধমৃত করে জীবনকে সহনীয় করে তোলার চেষ্টা করে।
আত্মপ্রেমী এবং আত্মগর্বী লোক অন্তত বিশ্বাস করে সুখ লাভ করা সম্ভব, যদিও তা পাওয়ার জন্যে তারা ভুল পথ অবলম্বন করে। কিন্তু যে লোক নেশার পথে এগিয়ে যায়, যে নেশাই তা হোক সে সবকিছুর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র বিস্মৃতি ছাড়া। তার ক্ষেত্রে প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, সুখ অবশ্যই প্রত্যেকের কাম্য। নিদ্রাহীন ব্যক্তি যেমন নিদ্রাহীনতার জন্যে গর্বিত, অসুখী ব্যক্তি তেমনি অসুখী হওয়ার জন্যে সবসময় গর্বিত থাকে। দারিদ্রের অহংকার, অতৃপ্তির অহংকার এসব কিছুই মনে হয় সেই লেজকাটা খেকশিয়ালের মতোই অহংকারের। যদি তা সত্যি হয় তাহলে তার প্রতিবিধান হল নতুন লেজ গজানোর শিক্ষা দান করা।