আত্মসচেতনতার উন্নতি কীভাবে করা যায়?
আত্মসচেতনতার ব্যাপারটা বৌদ্ধিকভাবে অনুধাবন করাটা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়; সহজ ভাষায় আত্মসচেতনতা হল দুটো প্রশ্নের উত্তর—
১. আমি কী করছি/কী অনুভব করছি ?
২. আমি কেন তা করছি/কেন এমন অনুভব করছি?
কিন্তু বাস্তবে আমরা অনেকেই আত্মসচেতন নই; আমরা প্রায়শই অন্যমনস্ক হয়ে যাই, অভ্যেসের বশে সামাজিক মাধ্যমে ঢুঁ মারি, আচম্বিতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলি, ভুল সম্পর্কে অথবা ভুল সময়ে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি । শুনতে আশ্চর্য লাগতে পারে কিন্তু আমাদের অনেকেই অনেক সময় “কী করছি” সেটাও জানি না, “কেন করছি”র কথা ছেড়েই দিলাম ।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি— কোরা বাংলায় বর্তমানে ধর্মীয় বিদ্বেষ, রেষারেষি আর ব্যক্তিগত আক্রমণ এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে এর মধ্যে জড়িয়ে না পড়াই একটা কঠিন ব্যাপার । যদিও সক্রিয়ভাবে নীরবকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমি আমার ফীড পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি (আর বর্তমানে আমার ফীড মোটামুটি ভদ্রস্থ বলা চলে), এই বিদ্বেষ-প্রতিবিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কখনই শূন্য হয়ে যায়না । কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটা উপলব্ধি করেছি তা হল যে আমার ফীডকে আমি নিয়ন্ত্রণ করছি না আমার ফীড আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা বোঝাটা জরুরি । একটা সময়ে যখন আমার ফীডে প্রায় প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো বিদ্বেষমূলক কিংবা উস্কানিমূলক প্রশ্ন/উত্তর দেখতাম তখন প্রতিক্রিয়া না দেখানোটা দুঃসাধ্য ব্যাপার বলে মনে হত । সামাজিক মাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসার পরও রাগ থাকতো আর কীভাবে পাল্টা জবাব দেওয়া যায় তাই চিন্তা করতাম ।
কিন্তু একটা সময় একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম— আমার ফীডে যখন ভালো মানের পক্ষপাতশূন্য প্রশ্ন কিংবা উত্তর আসছে তখন আমার সেগুলো পড়ার আগ্রহ জন্মাচ্ছে না । আমি স্ক্রোল করে এগিয়ে যাচ্ছি যতক্ষণ না কোনো উস্কানিমূলক প্রশ্ন চোখে পড়ছে ! সেরকম কোনো প্রশ্ন পেলেই রেগে যাচ্ছি আর উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠছে । আর উত্তর লিখে ফেললে কথাই নেই । বাঁকা মন্তব্য তো পাচ্ছিই, তাঁর সাথে ফীডে আরো বেশি করে এমন ধরণের প্রশ্নও । অর্থাৎ যাকে বলে একটা vicious cycle তৈরী হচ্ছে ।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু চমকেই গিয়েছিলাম । যে প্রশ্ন দেখলেই রাগ হয়, তাই আমি দেখতে চাইছি কেন? যে উত্তর পেলাম সেটা আরো অদ্ভুত— রেগে যাওয়াটাই আসলে আমি উপভোগ করছি । যে প্রশ্নে রাগ হচ্ছে না সেগুলোকে নিরস মনে হচ্ছে । তাই ভালো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কষ্টকর মনে হচ্ছে কিন্তু খোঁচা-দেওয়া প্রশ্নের উত্তর লিখতে তর সইছে না ।
কিন্তু কেন এমন একটা নেশায় জড়িয়ে পড়লাম? এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে পাল্টা ঘা দিতে পারাটা আসলে দারুন উপভোগ্য; আমায় ঢিল ছুঁড়লে আমার কাছে যে আরো বড় পাটকেল আছে সেটা বুঝিয়ে দেওয়াতেই আনন্দ । আর এর কারণেই রেগে-ওঠার-মতো প্রশ্নগুলোই আমি খুঁজে চলেছি আর খুঁজে পাচ্ছিও ।
আরো যেটা লক্ষ্য করলাম তা হল যে রাগের মাথায় উত্তর লিখে সাময়িক আনন্দ পেলেও পরে গিয়ে মনে তিক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে । যার প্রভাব অন্যান্য উত্তরেও পড়ছে; কর্কশ ভাষা প্রয়োগ করে ফেলছি । অথচ তারপরেও সেই রাগ-ধরানো প্রশ্নগুলোই আমাকে টানছে । আর এমনিভাবেই আমার ফীড আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, আমি আমার ফীডকে নই ।
এই উপলব্ধিটা স্পষ্ট হতেই মনে হল এর থেকে অবিলম্বে বেরিয়ে আসা দরকার । কিন্তু কোরা ছেড়ে দিতে মন চাইল না কারণ কেবলই মনে হতে লাগল যে এমনটা করার অর্থ হবে হার স্বীকার করে নেওয়া । অতএব শুরু করলাম সক্রিয় নির্বাককরণ, সেইসাথে উস্কানিমূলক প্রশ্নে ডাউনভোট দেওয়া ও রিপোর্ট করা । তারপর থেকে নিয়মিত করে চলেছি এটা; ফীডও কিছুটা উন্নত হয়েছে । তবে স্বীকার করছি যে উস্কানিমূলক মন্তব্যের জবাব না দিয়ে থাকাটা সবচেয়ে কঠিন । যদিও আগের চাইতে ভালোভাবে পারি, তবু সচেনতনভাবে নিজেকে বিরত রাখতে হয় ।
আত্মসচেতনতার পাঠ অবশ্য এখানেই শেষ নয়; এর পরেও যাওয়ার রয়েছে । যেমন এই রেগে ওঠার অস্বাস্থ্যকর নেশায় আসক্ত হওয়ার নেপথ্যে হয়তো রয়েছে নিজের জীবনে কোনো কারণে অসুখী হওয়া বা আনন্দে না থাকা । এর পরবর্তী ধাপে হয়তো দেখলেন আপনার আনন্দে-না-থাকার নেপথ্যে রয়েছে কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সম্পর্ক বিচ্ছেদের ঘটনাটা । এর থেকে হয়তো আবিষ্কার করলেন যে আপনি প্রাক্তনের প্রতি এখনো তিক্ততা পুষে রেখেছেন । তবে একটা পর্যায়ে এসে ভাবা বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে ভালো রাখার পদক্ষেপ নেয়াটাই শ্রেয় ।
আত্মসচেতনতার একটা আশ্চর্য উপকারিতা হল যে এতে শুধু নিজেকে ভালো বোঝা যায় তাই নয়, অন্যদেরও বুঝতে সুবিধা হয় । এতে করে হয়তো একসময় কারো কথা শুনে যেখানে আপনার রাগ হবার কথা সেখানে পরিবর্তে দুঃখ পাবেন—নিজের জন্য নয়, অপর ব্যক্তিটির জন্য । হয়তো মনে হবে সেও আপনার মতই একজন ভুক্তভোগী যার বিদ্বেষ আসলে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার ইঙ্গিত ।
না, সবার প্রতিই যে এমন সহানুভূতি জেগে উঠবে তা বলছি না তবে কেউ আপনাকে উস্কাতে চেষ্টা করছে দেখলে তার নেপথ্যে কী চিন্তা কাজ করছে সেটা বুঝতে পারবেন । কাউকে হয়তো দেখবেন অসুখী আবার কাউকে দেখবেন যে আপনার মজা নিতে চায়— দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিরাই হচ্ছে “ট্রোল” । এরাই সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রকৃতির; কারণ আপনাকে খুঁচিয়ে দিয়ে একটা প্রতিক্রিয়া পেলেই এদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ । আপনি কী লিখলেন, ঢিলের বদলে কত মোক্ষম পাটকেল মারলেন এতে তাঁদের কিচ্ছু যায়-আসবে না । আপনি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছেন মানেই ট্রোলের জয়জয়কার ।
মূলত ট্রোলদের এই ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্যই আমি প্রতিমন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার প্রয়াস শুরু করি । না, নিজেকে মহৎ-টহৎ প্রমাণ করার জন্য নয়, বরং শুনলে একটু স্যাডিস্টিক বলেই মনে হতে পারে— যদি ভেবে দেখা যায়, আমি যতক্ষণ না ট্রোলের মন্তব্যে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি (প্রতিমন্তব্য করা, মন্তব্য নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া, বা মন্তব্য মুছে দেওয়া), ট্রোল ব্যক্তির এটা বোঝার কোনো সাধ্য নেই যে আমি তাঁর মন্তব্য আদৌ দেখেছি কিনা । আর সেটা না বুঝতে পারলে তাঁর আনন্দ পাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই কারণ সে এটাই বুঝতে পারবে না যে আমার কাছে তাঁর কোনো অস্তিত্বও আছে কিনা ।
কাজটা করা কঠিন কিন্তু করতে পারলে দেখেছি চমৎকার কাজ দেয় ।
যাই হোক, মোদ্দা কথাটা হল আত্মসচেতনতা ব্যাপারটা বেশ কাজের জিনিস; আয়ত্ত করতে পারলে অনেক লাভ আছে । তবে আত্মসচেতন হওয়ার পর আরেকটা কাজ যেটা করা জরুরি তা হল নিজেকে মেনে নেওয়া; কিছু মানুষের জন্য এটা সত্যিই কঠিন, কিন্তু নিজেকে ভালো রাখতে গেলে এটা করা অবশ্যকরণীয় । কারণ নিজেকে (সাথে অন্যদের) ভালো রাখতে পারাতেই আত্মসচেতন হওয়ার প্রকৃত সার্থকতা, দোষারোপ করায় নয় ।