বিউটি পার্লারে গিয়ে বিভিন্ন সাজসজ্জা গ্রহণ করা সম্পর্কে কী বলে ইসলাম?
বিউটি পার্লারে গিয়ে বিভিন্ন সাজসজ্জা গ্রহণ করা সম্পর্কে কী বলে ইসলাম?
সাজগোজ করা, পরিপাটি থাকা এটি নারীদের স্বভাবজাত বিষয়। ইসলাম মেয়েদের স্বভাবজাত এ সাজসজ্জার মানসিকতার বিরোধী নয়। তবে এক্ষেত্রে শরয়ী সীমা অতিক্রম করা জায়েজ নয়। এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যা দ্ধারা আল্লাহ ও রাসূলের বিধান লঙ্ঘিত হয়। সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি হল, যে কাজ ইসলামে সম্পূর্ণ অবৈধ, সে কাজ কোনভাবেই কারো জন্যেই করা জায়েজ নয়। এমনকি স্বামীকে খুশি করার জন্যও করা জায়েজ নয়। আল্লাহর নবী [সা.] স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হয়ে কোন সৃষ্টির আনুগত্ব করা জায়েজ নয়। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১০৯৫, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৭০৭]
আর সাজগোজের যে সব বিষয় জায়েজ, তা গায়রে মাহরাম পুরুষদের দেখানোর জন্য করলে জায়েজ নয়, এতে করে সাজগোজকারী গোনাহগার হবে। তবে স্বামীকে খুশি করার জন্য যদি সাজগোজ করে তাহলে এতে সওয়াব পাবে। বর্তমানে প্রচলিত বিউটি পার্লারের অনেক কাজ জায়েজ হলেও অনেক নাজায়েজ কাজও রয়েছে। জায়েজ কাজগুলো যদি শরয়ী পর্দা রক্ষা করে করা হয়, তাহলে সে বিউটি পার্লার চালাতে শরয়ী কোন বাঁধা নেই। তবে যদি গায়রে শরয়ী কাজ করে, তাহলে যে করল সেও গোনাহগার হবে, যার মাধ্যমে করলো সেও গোনাহগার হবে।
চুল কাটা : নারীদের জন্য মাথার চুল যে কোন অংশ থেকেই হোক কাটা বা উপড়ানো কোনটিই জায়েজ নয়। কারণ এতে করে পুরুষের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। পুরুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ করার ব্যাপারে হাদীসে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস [রা.] থেকে বর্ণিত। রাসূল [সা.] অভিশাপ করেছেন সেসব পুরুষের উপর যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে, আর সেসব নারীদের উপর যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৮৫, ৫৫৪৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৯০৪]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- হযরত আলী [রা.] থেকে বর্ণিত। রাসূল [সা.] নারীদের চুল কামাতে নিষেধ করেছেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৯১৪, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৪৪৭, সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৫০৪৯]
এ কারণে নারীদের জন্য মাথার চুল কামানো জায়েজ নয়। তবে যদি কোন কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে প্রয়োজনের কারণে চুল কর্তন করা জায়েজ আছে। তবে এক্ষেত্রে যখনি উজর দূরিভূত হয়ে যাবে, তখন থেকে আর কাটা জায়েজ হবে না। একই হুকুম বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী মেয়েদের বেলায়ও প্রযোজ্য। অর্থাৎ তাদের জন্য চুল কাটানো জায়েজ নয়। তবে যদি বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী বয়সে উপনিত না হয়, তাহলে এমন শিশুদের সৌন্দর্য বাড়াতে, বা অন্য কোন কারণে সাজতে চুল কাটানোয় কোন সমস্যা নেই। তবে এক্ষেত্রেও কাফের বা ফাসেকদের ষ্টাইল বা ফ্যাশন নকল না করা উচিত।
চুল রং করা : চুল রং করা চুলকে রঙ্গীন করাতে কোন সমস্যা নেই। যদি অন্য কোন হারাম কাজ না করা হয়, তাহলে এমনিতে নারীদের চুল রঙ্গিন করাতে শরয়ী কোন নিষিদ্ধতা নেই।
চুল ঝুঁটিকরণ : চুল কাটা ছাড়া বিভিন্ন প্রকার ঝুঁটি ও ডিজাইন করাতেও শরয়ী কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। হযরত ইবনে আব্বাস [রা.] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি আমার খালা মায়মূনা বিনতে হারিসের নিকট রাত যাপন করছিলাম। ঐ রাতে রাসূলও [সা.] তাঁর কাছে ছিলেন। ইবনে আব্বাস [রা.] বলেন, রাসূল [সা.] উঠে রাতের সালাত আদায় করতে লাগলেন। আমি তাঁর বাম পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন তিনি আমার চুলে ঝুটি ধরে আমাকে তাঁর ডান পাশে নিয়ে দাঁড় করালেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৯১৯, ৫৫৭৫] তবে এক্ষেত্রে কাফের বা কোন ফাসেক নারীর ডিজাইন ও ষ্টাইল যেন নকল না করা হয় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ ফাসেক ও কাফেরের সাদৃশ্য গ্রহণ জায়েজ নয়।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর [রা.] থেকে বর্ণিত। রাসূল [সা.] ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। [আবু দাউদ শরীফ, হাদিস নং-৪০৩৩, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদিস নং-২৯৬৬, মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং-২০৯০৮৬]
ফ্যাসিয়াল ও হাত পা মালিশ করা : শরয়ী সীমায় থেকে সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে নারীদের জন্য ফ্যাসিয়াল করা, ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা, হাত পা মালিশ করা জায়েজ আছে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন শরয়ী সীমা লঙ্ঘিত না হয়। যেমন মালিশ করতে গিয়ে যে অঙ্গ ধরা স্বামী ছাড়া কারো জন্য জায়েজ নয়, তা স্পর্শ করা ইত্যাদি। যদি এমনটি করা হয়, তাহলে তা হারাম হবে।
ভ্রূ চিকন করা ভ্রূ সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা : ভ্রূ চিকন করা ভ্রূ সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা জায়েজ নয়। হারাম। হাদীসে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ [রা.] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে যে নারী উলকী উৎকীর্ণ করে ও করায়, যে নারী ভ্র উপড়ে ফেলে এবং যে নারী দাঁত কেটে সরু করে দাঁতের মাঝখানে ফাঁক বানায়, যে কাজগুলি দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে পরিবর্তন সাধিত হয়, এদের উপর আল্লাহ তাআলা অভিশাপ বর্ষণ করুন। আমি কেন তার উপর অভিশাপ বর্ষন করবো না, যাদের উপর আল্লাহর রাসূল অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। সেই সাথে তা আল্লাহ তাআলার কিতাবেই বিদ্যমান আছে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৯৪৩, ৫৫৯৯, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-১৪৬৭] তবে হিজড়াদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হলে ভ্রুকে কেঁচি দিয়ে ছোট করা জায়েজ আছে। যেমন- ফাতাওয়া শামীতে এসেছে হাত-পা ও চেহারার চুল উপড়ে ফেলা নারীদের শরীরের অতিরিক্ত লোম ও চুল উপড়ে ফেলা জায়েজ আছে। যেমন- দাড়ি মোচ, লোম ইত্যাদি।
বধুসাজ : ইতোপূর্বের আলোচনা দ্বারাই একথা বুঝে এসে গেছে যে, সাজগোজ করাতে ইসলামী শরীয়তে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। যদি না কোন হারাম উদ্দেশ্য হয় কিংবা কোন হারাম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে সাজগোজ করাতে কোন সমস্যা নেই। আর স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে সাজগোজ করতে শরীয়ত স্ত্রীকে উদ্ভুদ্ধ করে থাকে। তাই স্বামীর জন্য স্ত্রীকে সাজিয়ে দেয়া বা স্ত্রী নিজেই সাজগোজ করাতে কোন সমস্যা নেই। তবে যদি অন্য কোন শরীয়ত বিরোধী এতে অনুপ্রবেশ করানো হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। শেষ কথা এক বাক্যে যেমন পার্লারকে নাজায়েজ বলা যাবে না, ঠিক তেমনি এক বাক্যে তাকে জায়েজও বলা যাবে না। উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, হারাম কাজ না করলে পার্লার খোলা জায়েজ আছে, আর হারাম কাজ করা হলে জায়েজ নয়।
উত্তর লিখেছেন- মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
গ্রন্থনা ও সম্পাদনা- মাওলানা মিরাজ রহমান