মনোবিজ্ঞান কী?
আমাদের যেমন শরীর খারাপ হয়, ঠিক তেমনই মনেরও শরীর খারাপ হয়। এই মনের শরীর খারাপ হওয়াকে নির্ধারণ করা ও সুস্থ করার বিজ্ঞানই হল মনোবিজ্ঞান।
মনোবিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্ববিদ্যা হল , মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণ সম্পর্কিত বিদ্যা ও অধ্যয়ন। এটি বিজ্ঞানের একটি তাত্ত্বিক ও ফলিত শাখা যাতে মানসিক কর্মপ্রক্রিয়া ও আচরণসমূহ নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করা হয়। বিভিন্ন বিজ্ঞানী মনোবিজ্ঞানকে “মানুষ এবং প্রানী আচরণের বিজ্ঞান” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আবার অনেক বিজ্ঞানী একে সংজ্ঞায়িত করেছেন “আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার বিজ্ঞান” হিসেবে।
আমরা প্রতিদিন অনেক ধরণের কাজ করি। চেতন কিংবা অবচেতন মনে আমরা অনেক কাজ করে ফেলি কিংবা করতে পছন্দ করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা কিন্তু জানিনা এই কাজগুলো আমরা কেন করি! ‘নিজেকে জানো’ মতবাদ নিয়ে সক্রেটিস বেশ মুক্ত আলোচনা করেছিলেন। সারাজীবন তিনি ব্যয় করেছেন এই নিজেকে জানার মধ্যে। যদিও নিজেকে জানার জন্য সক্রেটিসের “নিজেকে জানো” পন্থাটি যথেষ্ট ছিলো, তবুও সত্যিকার অর্থে আমরা নিজের সম্পর্কে খুবই কম জানি। বেশ চাঞ্চল্যকর হলেও সত্যি যে, আমরা নিজের সম্পর্কে যা জানি, অন্যের সম্পর্কে তার চেয়েও বেশি জানি। অন্যের ভালো, খারাপ, প্রশংসা, নিন্দাসহ বেশ কিছু উপর্সগ কিংবা অনুসর্গ আমরা ধরতে পারলেও নিজের সম্পর্কে আমরা আসলে অনেক কিছুই জানিনা।
মনোবিজ্ঞানের ইংরাজি প্রতিশব্দ ” Psychology” -এর উৎপত্তি হয়েছে দুটি গ্রীক শব্দ “Psyche” এবং “Logos” এর মিলিতরূপে। “Psyche” অর্থাৎ মন বা আত্মা।”Logos” এর অর্থ বিজ্ঞান।
মনোবিজ্ঞানের শাখাগুলিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়ঃ ১) মৌলিক ও ২) ফলিত
১) মৌলিক মনোবিজ্ঞানঃ এই শাখার উদ্দেশ্য হল মানুষের আচরনের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে আচরনের মূলনীতি ও তত্ত্ব আবিষ্কার।
২) ফলিত মনোবিজ্ঞানঃ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মনোবিজ্ঞানের মূল নীতির প্রয়োগ ঘটানো।
মনোবিজ্ঞান নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে আমরা কীভাবে পৃথিবীকে উপলব্ধি করি এবং আমাদের আচরণকে কে নিয়ন্ত্রণ করি তার উত্তর জানার চেষ্টা করে আসছেন। বিজ্ঞানের এই পর্যায়ে এসে তারা বেশ সফল হয়েছেন এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অনেক কাজের কারণ তারা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন।
মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসঃ
উনিশ শতকের আগে মন সম্পর্কীয় সকল অধ্যয়ন দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দার্শনিকগণ মানসিক আচার-আচরণ বা ক্রিয়া-কলাপ সম্পর্কে কেবল অনুমান করেছিলেন। মন সম্পর্কে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা করেন। তিনি মনকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে গণ্য করেন। আধুনিক যুগে স্নায়ুবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে মনোবিজ্ঞানেরও নব বিকাশ ঘটে ও আধুনিক বিজ্ঞানের এক অন্যতম শাখা হিসাবে মনোবিজ্ঞানের বিকাশ আরম্ভ হয়। স্নায়ুবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানের মধ্যেই যে মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক ভিত্তি নিহিত হয়ে আছে সেই কথা সর্বপ্রথম বলেন জার্মান শরীর বিজ্ঞানী জোহানেস পিটার মূলার। অবশ্য মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটি করেছিলেন আরেকজন জার্মান বিজ্ঞানী হারমেন ভন হেল্মলটেজ । ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী টমাস ইয়ঙের প্রস্তাবিত রং সংক্রান্ত নীতি নিয়ে গবেষণা করে তিনি “ইয়ং হেল্মলটেজ সুত্র” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সূত্র দ্বারা তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে তিনটে বিভিন্ন রঙের (সবুজ, নীল ও লাল) অনুভূতির সৃষ্টি হয় মানুষের চোখের রেটিনার সাথে সংযুক্ত তিন ধরনের স্নায়ুর কর্ম-তৎপরতার ফলে। এরপর পরবর্তী আধুনিক মনোবিজ্ঞান একের পর আরেক আমাদের মন সম্পর্কীয় রহস্য উদঘাটন করে এর জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে।
এই জটিল বিজ্ঞানের বহু শাখা প্রশাখা আছে। প্রতিটি শাখার বিচিত্রতা ভিন্ন ভিন্ন। তবে সব কিছুর উদ্দেশ্য একটাই। মনকে সুস্থ রাখা। যাতে শরীরও সুস্থ থাকে। কারণ মন ও শরীর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান যুগের পারিপার্শ্বিক চাপে মানুষ অসহায়তার শিকার হয়ে মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার থেকে মুক্তির উপায় বলে দেয় মনোবিজ্ঞান।