মাজের মধ্যে প্রত্যেকেই চাঁদে মানব অবতরণের বিস্ময়ক ঘটনা অবগত। বিশ্ব ইতিহাসের এই চমকপ্রদ ঘটনাটি সর্বপ্রথম ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই রাত ২টা ১৬ মিনিটে। চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানব চাঁদের তথাকথিত ‘কলঙ্ক’ অর্থাৎ ক্ষত চিহ্নের যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তা কেউ এখনও ভুলে যায়নি। এর পরেও কি অস্বীকারকারীদের বোধোদয় হবে না?
৮. মালাবারের রাজা ভোজের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ছিল শক্কে কমর বা চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার ফল। আমাদের পরবর্তী আলোচনা রাজাভোজ। প্রসঙ্গক্রমে অনেকের মধ্যে বিদ্যমান একটি ভ্রান্ত ধারণা বা অন্ধ বিশ্বাসের অবসান ঘটানো দরকার। তা হচ্ছে এই যে, দ্বিখণ্ড চাঁদের এক খ- জমিনে পতিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জামার কলারে ঢুকে পড়ে এবং আস্তিনের (হাতা) ভেতর দিয়ে বের হয়ে যায়, এটি নিছক কল্পনা এবং ভিত্তিহীন ধারণা। বিশিষ্ট মোহাদ্দেসীনে কেরাম যে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে এরূপ ধারণার প্রমাণ নেই। তারা বলেন, চাঁদ দ্বিখণ্ড হয়ে যায় এবং যথেষ্ট ব্যবধানে উভয় খণ্ড আলাদা হয়ে যায়, উভয়ের মাঝে হেরাপর্বত দৃষ্টিগোচর হয়। চাঁদ সম্পর্কে আরও নানা অলীক কথা শোনা যায়। চাঁদের ফাঁকা স্থান বা ক্ষত চিহ্ন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মোজেযারই অংশবিশেষ। একে চাঁদের ‘কলঙ্ক’ বলে আখ্যায়িত করাও উচিত নয়।
মহানবী (সাঃ) – এর যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত করার ঘটনা রয়েছে, সেই ঘটনাটার বর্ণনা কি ছিল ?
মহানবী (সাঃ) – এর যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত করার ঘটনা রয়েছে, সেই ঘটনাটার বর্ণনা কি ছিল ?
হিজরতের পূর্বে মক্কা মোআজ্জামায় আবু জেহেল, অলীদ ইবনে মুগীরা, আছ ইবনে ওয়ায়েল প্রমুখ কোরাইশ কাফের নেতৃবর্গ সমবেত হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আবেদন জানায় যে, আপনি যদি সত্য নবী হয়ে থাকেন তাহলে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করে দিন। তিনি বললেন, আমি যদি (তোমাদের দাবী অনুযায়ী) এরূপ করে দিতে পারি তা হলে তোমরা কি ঈমান আনবে? তারা বলল, হাঁ, আমরা ঈমান আনব। রসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর এরূপ হওয়ার জন্য দোয়া করলেন। অর্থাৎ চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার জন্য দোয়া করলেন। তখন তাঁর নির্দেশে চাঁদ দুই টুকরা হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রত্যেক কাফেরের (উপস্থিত) নাম উচ্চারণ করে বলতে থাকেন, হে অমুক! হে অমুক!! সাক্ষী থাক। তখন উপস্থিত সকল লোকেই উত্তম রূপে প্রত্যক্ষ করল যে উভয় খ- এতই পার্থক্য হয়ে গিয়েছিল যে, উভয়ের মাঝে হেরা পর্বত দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। কাফেরগণ বলে উঠল, এটা হচ্ছে তাঁর জাদু। আবু জেহেল বলল, এটা জাদু হলে জাদুর প্রভাব কেবল তোমাদের উপরই পড়ার কথা, এটাতো হতে পারে না যে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উপর পড়বে। আবু জেহেল আরো বলল, শহরের লোকেরা যারা তোমাদের নিকট আসবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এবং বিভিন্ন দিক দিগন্ত হতে যারা আসবে তাদেরকেও জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাদের আগমনের পর সকলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা সবাই বলল যে, আমরা চাঁদ দ্বিখ-িত হওয়ার দৃশ্য অবলোকন করেছি।
হাদীস সংকলনের তৃতীয় যুগের মোহাদ্দেসীনে কেরামের মধ্যে একজন বিখ্যাত মোহাদ্দেসেুর নাম আবু নোআইম (নাঈম) আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ ইস্কাহানী (৪৩১ হি.)। তার সংকলিত ‘দালায়েলুন নবুওয়াতি’ প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ। এতে আতা ও জেহাক সূত্রে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ বর্ণনায় পূর্বে উল্লেখিত তিনজন কাফের নেতা ছাড়াও আছ ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে মোত্তালেব এবং নজর ইবনে হারেসের নাম রয়েছে যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার দাবী জানিয়েছিল। এই বর্ণনায় তারা স্পষ্ট দাবী জানিয়েছিল, ‘ইনকুনতা ছাদেকাফা শাক্কে লানা আল কামারা (কিরকাতাইনো নিছফান আলা আবি কোবাই সে ওয়া নিছকাল আলা কাইকুআনে।’ কাফেররা বলল, আপনি যদি সত্যবাদী হন তা হলে চাঁদকে দ্বিখ-িত করে আমাদেরকে দেখান, যার অর্ধেক আবু কোবাইস পর্বতে এবং অর্ধেক কাইকুআন পর্বতে পতিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি যদি তা করে দেই তাহলে তোমরা ঈমান আনবে কি? তারা বলল, হাঁ। বর্ণনাকারী বলেন, রাতটি ছিল পূর্ণিমার। রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন, তারা (কাফেররা) যা চায় তা যেন আল্লাহ তাকে দান করেন। অতঃপর চাঁদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অর্ধেক আবু কোবাইল পর্বতে পতিত হয় এবং অর্ধেক কাইকুআন পর্বতে পতিত হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু সালমা, হে আবদুল আসাদ এবং হে আরকাম ইবনে আরকাম, তোমরা সবাই সাক্ষী থাক। এ বর্ণনা হতে জানা যায় যে, কাফেরগণের পক্ষে হতেই দাবী করা হয়েছিল যে, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করে উল্লেখিত দুই পর্বতে পতিত করতে হবে।
গ্রীক দার্র্শনিকদের একটি দল তারা কাফের-মুশরিকদেরও ছাড়িয়ে যায় এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মোজেযাকে অস্বীকারই করে না, তারা তাদের ভ্রান্ত নীতি দর্শন অনুযায়ী বলতে থাকে, আকাশ ও গ্রহ-উপগ্রহের পক্ষে বিদীর্ণ হওয়াও সংযুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তারা আরও প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মতো মোজেযা সংঘটিত হয়ে থাকলে তা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পেত অথচ ইতিহাসে এই ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। সুতরাং এই ঘটনার কোন বাস্তবতা নেই। তাছাড়া গণক, জ্যোতিষীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেনি, ভবিষ্যৎ বক্তারাও এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। এ ধরনের নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে দার্শনিক-বিজ্ঞানীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সত্য ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা কম করেনি। এ ব্যাপারে তারা গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করে একশ্রেণীর মুসলিম সীরাত লেখককেও বিভ্রান্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যার জন্য আরেক সীরাত গ্রন্থে শক্কে কমরের মোজেযা সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পায়নি বলে দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের অভিযোগ যে কত ভিত্তিহীন তা নিম্নের আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
১ ‘শক্কল কামারে’র মোজেযা মক্কার কাফেরদের একটি বিশেষ দাবির প্রেক্ষিতে সংঘটিত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) সেই দাবী পূরণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করেন এবং আল্লাহ তাঁর সেই দোয়া কবুল করেন।
২. মক্কাবাসীরা ছাড়াও আশপাশের এলাকা হতে আগত মোসাফিরগণও চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সাক্ষ্য দান করে।
৩. যদি ধরেও নেয়া যায় যে, ঘটনাটি সকল স্থানে দেখা যায়নি এর কারণ কি? জবাবে বলা যায় চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্যের কারণে কোন কোন স্থানে চাঁদ উদিতই হয়নি। এ জন্য চন্দ্র গ্রহণ সব স্থানে পরিলক্ষিত হয় না এবং কোন কোন সময় অন্যান্য স্থানে মেঘাচ্ছন্ন বা পর্বত ইত্যাদি চাঁদের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।
৪. ‘খিরকে ইলতিয়াম’- একটি বিশেষ পরিভাষা। খিরক অর্থ হচ্ছে ফেটে যাওয়া, চিরাচরিত নিয়মনীতি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছু ঘটে যাওয়া, ব্যতিক্রম, অভিনব, নবী-রাসূলগণের মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনা। এর বহু বচন খাওয়ারেকা। আর ইলতিয়াম শব্দের অর্থ, পরস্পর দুই বস্তুর মিলিত হওয়া। সুতরাং ঘিরকে ইলতিয়াম বলা হয়, সৌরম-লে অর্থাৎ আকাশ, তারকারাজি তথা গ্রহ-উপগ্রহ ইত্যাদি ফাটল-মিলন বা ব্যতিক্রমী ঘটনাবলী। মুসলমানদের কাছে আকাশ নক্ষত্ররাজির মধ্যে এসব অবস্থার সৃষ্টি হওয়া খুবই সম্ভব। এর বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, কেয়ামতের সময় আসমান ও তারকারাজি ফেটে তুলাতুলা হয়ে যাবে যার বর্ণনা কোরআনের বহুস্থানে রয়েছে। এতদসংক্রান্ত বহু হাদীসেও এ বর্ণনা এসেছে। ‘হেকমত’ বা যুক্তিশাস্ত্র অনুযায়ী ও দার্শনিকদের যুক্তি বাতিল-অচল এ সম্পর্কে গ্রীসের বিখ্যাত প্রাচীন দার্শনিক ফিসাব্যারাম ‘হাইয়াত’ বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে, তারকারাজি মৃত্তিকার ন্যায় খুব ঘন, পুরু এবং সমস্তই লীন, ধ্বংসযোগ্য এবং তাদেও ফাটল-মিলন ঘটবে। অতএব বিনাদ্বিধায় প্রমাণিত যে, চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা একটি অকাট্য সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত, এতে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।
৫. প্রাচীন ঐশী গ্রন্থ ‘তওরাতে’ বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইউশা (আ.)-এর জন্য চলমান সূর্য থেমে গিয়েছিল, অথচ এ ঘটনা কোন ইতিহাস গ্রন্থে লিখিত হয়নি, যদিও এটি ছিল দিনের ঘটনা। সুতরাং ঘটনাটি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ না থাকলে তার বাস্তবতা মিথ্যা হতে পারে না। কাজেই রাতের ঘটনা ‘শক্কে কমরকেও অস্বীকার করা যায় না। মুসলমান ঐতিহাসিকদের আরবী, ফার্সী, উর্দু, বাংলাসহ বিশ্বের নানা ভাষায় রচিত প্রাচীন ও আধুনিক বহু গ্রন্থে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মোজেযা সংক্রান্ত হাদীসও অন্যান্য অসংখ্য গ্রন্থে, পদ্যে-গদ্যে শক্কে কমরের ঘটনার বিবরণ, আভাস, ইঙ্গিত ছাড়াও কোরআনে সূরা ‘কামার’ অপেক্ষা বড় দলিল আর কি হতে পারে!
৭. শক্কে কমরের মোজেযা অস্বীকারকারী আধুনিক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী স