পুরোনো দিনগুলো তোমায় কি পিছু ডাকে? ফটো দিয়ে বোঝাতে পারবে?
পুরোনো দিনগুলো তোমায় কি পিছু ডাকে? ফটো দিয়ে বোঝাতে পারবে?
পারলাম না গো…পুরোনোদিনের ছবিগুলো মায়ের কাছে। শিলচরের ছবি, আসাম টাইপ বাড়ীগুলোর ছবি, ন্যারো গজের ট্রেন, শিলচরের ল্যাম্প লাগানো রিক্সা, দেবদূত অন্নপূর্ণা সিনেমা হল, গান্ধীমেলা, বরাক নদী, অন্নপূর্ণা ঘাট, বাস স্ট্যান্ড। উফফফ…কি দিন ছিল ! বাড়ী ভর্তি লোক, পাড়া ভর্তি বন্ধু, রমজানের দোকানের সামনে রিক্সা থেকে নেমে মালপত্র মাথায় করে টিলার উপরে আমাদের বাড়ী পৌঁছানো ! সারা শহর হেঁটেই চলতো সবাই। স্কুল কলেজ অফিসে বেশীরভাগ লোক হেঁটেই চলে যেত। বিকেল হলেই দৌড় দৌড় খেলার মাঠে। হাডুডু, বন্দি, রুমাল চুরি, L O N D O N , লুকোচুরি, খো খো, ব্যাডমিন্টন, রিং, সেভেন স্টোন…কত্ত কত্ত খেলা বাবারে ! সন্ধ্যে হলেই ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে পড়াশোনা। মায়ের পায়ের শব্দ শুনলেই জোরে জোরে পড়া মুখস্ত করা। সক্কালবেলা ব্রাশ করে অনিচ্ছাসত্বেও হারমোনিয়াম নিয়ে সারেগামা সাসা রেরে গাগা করা। হায় রে…কোথায় গেল সেই হারমোনিয়াম আর আঁ আঁ করে গান ? রবিবারে ফাটকবাজার থেকে মাংস আসতো…বাবা সিগারেট মুখে ঝুলিয়ে রান্না করতেন। পাশে থাকতো চায়ের কাপ। চা সিগারেট রান্না একসাথে চলতো। মা হতেন সেদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট। পেঁয়াজ বেঁটে দাও…গরম মশলা বেঁটে দাও…জিরে বাটা কই ? দুপুরে আমরা চারজন পিঁড়িতে বসে মাংস পোলাও খেতাম। এখন ভাবলেই চোখে জল আসে। বাবা বোন দুজনে গত। মায়ের বয়স হয়েছে। একা ঐ বাড়ীতে থাকেন। সন্ধ্যের পর রকিং চেয়ারে বসে দুলে দুলে টিভি শোনেন…চোখটা একদমই গেছে যে। আমি দুরে পড়ে আছি…সংসারে আবদ্ধ।
শিলচর গেলে আজকাল আর ভালো লাগেনা। মা আছেন তাই যাই। কিন্তু আমার আগের শহর আর নেই। ভীড়ভাট্টা অসম্ভব …গাড়ীর জন্য রাস্তায় হাঁটা যায়না। সবাই গাড়ীতে আজকাল চলাফেরা করে। পাড়ার জ্যেঠু জ্যেঠিমারা আর নেই…দাদু দিদারা তো কবেই আকাশে চলে গেছেন। বন্ধুবান্ধবরা নেই…যে যার চাকুরিস্থলে ব্যস্ত, সংসার নিয়ে ব্যস্ত। পাড়ার দাদা বৌদিদের বয়স হয়ে গেছে। সবাই একা একাই থাকেন। পাড়াটা বুড়োবুড়ীতে ভরা। গেলেই শুধু অসুখের গল্প আর কষ্টের গল্প। ভালো লাগেনা। এই দাদাদের একদিন দাপিয়ে ফুটবল খেলতে দেখেছি। রক্তদান শিবিরে দেখেছি। নাটকের মঞ্চে দেখেছি। প্রেম করতে দেখেছি। টোঁপর মাথায় বৌ আনতে দেখেছি। সেই দাদাবৌদিরা এখন বয়স্ক, অসুস্থ। জাস্ট নেওয়া যায়না।
আমার কলেজটাও কেমন জানি পাল্টে গেছে। নতুন বিল্ডিং হয়েছে। নতুন নতুন বাচ্চা বাচ্চা স্যার আর ম্যাডাম। আমার ব্যাচমেট এখন কলেজে প্রিন্সিপাল ! যে রুমে ঢুকতে বুক কাঁপতো সেই রুমে আমার ব্যাচের কেউ বসে আছে ভাবতেই কেমন লাগে। তবে কলেজের তেঁতুল গাছটা আছে। অফ পিরিওডে আমরা সবাই তেঁতুল গাছের বেদীতে পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে কত গল্প করতাম। ঘন্টা বাজলে যে যার ক্লাসরুমে দৌড়ে ঢুকেছি। আর হাসি ! কি হাসি কি হাসি ! যা দেখি তাতেই হাসি পেত। স্কুল কলেজে দিনে একবার হলেও হেসে হেসে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছি। এত হাসি যে কোথা থেকে আসতো কে জানে ? এখনও হাসি আছে, আনন্দ আছে কিন্তু সেই অনাবিল আনন্দটা বোধহয় নেই।
অতীতের কথা ভাবতে এমনিতে ভালোই লাগে কিন্তু সাথে কিছু প্রিয়জনের চেহারা মনে এলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।